
শাহ্ সুফি মুজাম্মিল আলী (রঃ) জীবন-কর্ম
শাহ্ সুফি মুজাম্মিল আলী (রঃ) জীবন-কর্ম
কবি সাংবাদিক আনোয়ার হোসেন রনি
কর্ম জীবন
বাংলার সুফিবাদের আর্বিভাব কাল সঠিকভাবে বলা কঠিন। তবে একাদশ শতাব্দীর মধ্যভাগ থেকে সপ্তদশ শতাব্দীর পর্যন্ত এদেশে ইসলামের সর্বাধিক প্রচার ও প্রসার হয়েছে বলে জানা গেছে। আরব, ইরাক, ইরান, খোরাসান, মধ্য এশিয়া ও উত্তর ভারত থেকে সুফিরা এসে এদেশে সুফিবাদ প্রচার করেন। খ্রিষ্টীয় একাদশ-দ্বাদশ শতাব্দীতে যেসব সুফি সাধক এদেশে ইসলাম প্রচারে আত্মনিয়োগ করেন। তাদের মধ্যে উল্লেখ্যযোগ্য হলেন হযরত শাহজালাল (রঃ) ইয়ামনি সহ ৩৬০ জন অলি-আউলিয়া প্রায় সাতশত বছর আগে সুদূর ইয়ামন থেকে বাংলার মাটি ও শ্রীভূমি সিলেটে পদার্পন করেছিলেন খ্যাতিমান দরবেশ হযরত শাহজালাল ইয়ামনি (রঃ) যিনি আধ্যাত্বিক ক্ষমতার বলে বিনা সংঘাতে গৌর গোবিন্দকে পরাজিত করে গৌর রাজ্যে ইসলামের বিজয় নিশান উড্ডয়ন করেছিলেন। ন¤্র বিনয়ী মনোভাব ও অকৃত্রিম ভালোবাসা দিয়ে তিনি সকল ধর্মেও সকল মানুষের মন জয় করে একটি ইসলামী রাষ্ট্র ব্যবস্থা প্রতিষ্ঠা করে সভ্যতার গোড়াপত্তন করেছিলেন। তিনি আধ্যাত্বিক ভাব জগতে ভাব ভক্তি বিশ^াসের সহিত প্রগাঢ় শ্রদ্ধার পাত্র হিসেবে তিনি মানুষের মনে বেচে আছে। যার পদাঙ্কনে ধণ্য সিলেটে ও সুনামগঞ্জের মানুষসহ গৌরবান্বিত গোটা দেশ ও জাতি, তিনি উপমহাদেশের একজন শ্রেষ্ট মহামনীষী। অবাক লাগে! এ অলি দরবেশ মনীষী জীবনী আলেখ্য লিখিত কোনো সঠিক জীবনী খোজে পাওয়া কঠিন। বাংলার সাহিত্যের প্রাচীন লোক এতিহ্যের ফসল মরমীবাদ। মারেফতি বা ফকিরালী গজল, গানের পোশাক নাম হলো মরমী সাহিত্য। বৃহত্তর সুনামগঞ্জে তথা ছাতকসহ পাহাড়, পর্বত রয়েছে জানা অজানা অলি, দরবেশ এর অফুরান্ত লোকসাহিত্যে অসীম সম্পদ। যা রক্ষণা-বেক্ষণের অভাবে আজ হারিয়ে যাচ্ছে। সুফি, কবি, দার্শনিক এই ইসলাম প্রচারে পাশাপশি তারা অসংখ্য কারামত দেখিয়েছেন। এছাড়া নাগরি লিপি ভাষার ¯্রষ্টা জনক বলা হয়েছে এ উপজেলার আধ্যাত্বিক ফকির আফজল শাহ ওরফে আরমান আলীকে। নুর পরিচয়, রিসালের মারফতিসহ লোকসাহিত্য সুফিবাদকে প্রসার লাভ করে গেছেন। বাংলার মাটিতে নুর পরিচয়সহ ৮টি পান্ডলিপির মাধ্যমে মনীষী পান্ডিত্যের অধিকারী ছিলেন তিনি। সিলেটের হবিগঞ্জ, মৌলভীবাজার সহ বিভিন্ন স্থানে অলৌকিক ভাবে কারামত দেখিয়েছেন তারা। ১২০৪-৫ খিষ্ট্রাব্দে বখতিয়ার খলজী কর্তৃক বাংলার বিজিত হলে ইসলামের শরীয়ত ও মারিফত উভয় ধারায় প্রচার ও প্রসার তীব্রতর হয়। শাসক শ্রেনীর সাথে বহু পীর দরবেশ এদেশে আগমন করে ইসলাম প্রচারে মনোনিবেশ করেন। মুসলিম বিজয়োত্তর যে ক’জন সুফি দরবেশ ইসলাম ও সুফিবাদ প্রচারের গুরুত্বপূর্ণ ভুমিকা পালন করে গেছেন। আধুনিক যুগের ফার্সি, উর্দ্ধু, ও নাগরি সাহিত্যে অন্যতম শ্রেষ্ট জনক হিসেবে বিবেচনা করা হয় আমাদের বৃহত্তর ছাতক উপজেলার কৃতি সন্তান আধ্যাত্বিক জগতে অসীম ক্ষমতাধর ব্যক্তিত্ব আফজল শাহ ওরফে আরমান আলী। তার নাগরি লিপি ভাষার নুর পরিচয় বই নিয়ে প্রকাশকদের লোকচুরি করা হচ্ছে বলে একাধিক মানুষর অভিযোগ করছে। সুফি, তার ধর্মীয় ইসলামের রাজনৈতিক দর্শনের জন্যও বিশেষভাবে সমাদৃত ছিলেন। তার নাম হযরত শাহ্ সুফি মোজাম্মিল আলী (রহঃ) হলে তিনি “সুফি সাহেব” হিসেবেই সব মহলের কাছে শ্রদ্ধার পাত্র। তার সৃজনশীলতার জন্য বৃহত্তর সিলেটের ছিলেন সর্বাধিক প্রসিদ্ধ। তিনি সিলেটের সুফি নামে পরিচিত। ফুলের যেমন সৌরভ আছে, ঠিক তেমনি মানুষের ও সৌরভ আছে। হযরত শাহ্ সুফি মোজাম্মিল আলী (রহঃ) এমন একজন মানুষ ছিলেন। যার সৌরভ গৌরবান্বিত ছাতকবাসী। সুফি সাহেব সেই ফুলটির ঘ্রাণে দেশের হাজার হাজার মানুষ আজও মতোয়ারা। এই সুন্দর পৃথিবী থেকে চিরদিনের জন্য তিনি আমাদের ছেড়ে চলে গেলে ও তার গৌরব ছড়ায়। তার নিজ হাতে গড়া প্রতিষ্ঠান আজ দ্বীনি শিক্ষা বিস্তারের অগ্রণী ভূমিকা পালন করেছেন। তার প্রতিষ্ঠিত মসজিদ, মাদ্রাসা এর ধর্ম প্রাণ মানুষের ইবাদত বন্দেগীতে মুখরিত হয়ে উঠেছে। তিনি ছিলেন আধ্যাত্বিক দরবেশ ও কীর্তিমান ব্যক্তিত্ব হযরত শাহ্ সুফি মোজাম্মিল আলী (রহঃ)৩৬০ আউলিয়ার স্মৃতি বিজড়িত পূণ্য ভূমি সিলেট জেলার সদর উপজেলার মোগলগাঁও ইউনিয়নের সৈয়দপুর নামক গ্রামে প্রাকৃতিক সুন্দর্য্যরে লীলাভূমি সবুজ শ্যামল পল্লীতে তার জন্ম হয়। জন্মের সঠিক সন তারিখ জানা যায় নি। জনশ্রæতি ধারণা মতে তিনি ১৯৩১ সালে জন্ম গ্রহণ করেন। তার পিতা পীর মোহাম্মদ ওয়াজিদ আলী (রহঃ) মাতা পূণ্যময়ী হেলিমা খাতুন চৌধুরী। ৫ ভাই ২ বোন ছিলেন। পিতা মাতার পাঁচ পুত্র ২ কন্যা সন্তানের মধ্যে ছিলেন হযরত শাহ্ সুফি মোজাম্মিল আলী (রহঃ) পঞ্চম। হযরত শাহ্ সুফি মোজাম্মিল আলী (রহঃ) মাতা ছিলেন সিলেটের কামালবাজারস্থ ছোট দির্ঘলী শহীদ সুলেমান নগর হিসেবে পরিচিত। এই গ্রামের মরহুম পীর উসমান আলী (রহঃ) কন্যা ছিলেন। পিতা মরহুম পীর ওয়াজির আলী (রহঃ) সঙ্গে শুভ বিবাহ বন্ধনে আবদ্ধ হন ঐ পীর সাহেব জাদীর সাথে। তার পিতা মাতা ছিলেন আধ্যাত্বিক দরবেশ। তার মামা পীর হযরত আব্দুল জলিল চৌধুরী (রহঃ) ছিলেন সেই যুগের একজন খ্যাতনামা আধ্যাত্বিক দরবেশ। হযরত শাহ্ সুফি মোজাম্মিল আলী (রহঃ) কে তার পিতা ছোট বেলা থেকে আদর স্নেহ করে “সফর আলী” নামে ডাকতেন। পিতার ডাক নাম সত্যিই তার জীবন ফুটে। “সফর আলী” আরবি শব্দ অর্থ হলো- সফর করা বা ভ্রমণ করা। হযরত শাহ্ সুফি মোজাম্মিল আলী (রহঃ) ছোট বেলা থেকে নিজ গ্রামে প্রাথমিক বিদ্যালয় সমাপ্ত করে সৈয়দপুর থেকে সফরে বের হয়ে ৭০ বছর পর্যন্ত কখনো গ্রামের বাড়িতে ফিরে যান নি। এই কীর্তিমান মনীষী জীবনের শেষ নিঃশ্বাস সফর অবস্থায় ত্যাগ করেছেন। যে স্থানে সফর আলীর জীবন সমাপ্তি ঘটেছিল সেই স্থানটি তা স্মৃতি বিজড়িত ”সুফি নগর” নামে পরিচিতি লাভ করেছেন। শিল্প শহর ও ছাতকবাসীকে করে গেছেন আলোকিত। ইলমের আলো গোটা এলাকায় ছড়িয়ে পড়েছে। হযরত শাহ্ সুফি মোজাম্মিল আলী (রহঃ) সৌভাগ্যও এই সুন্দর পৃথিবীতে জন্ম গ্রহণ করেন সিলেট জেলার সৈয়দপুর গ্রামের সাথে প্রাকৃতিক ও মাতোয়ারা আনন্দের আস্ফালনে অমানিশা কালো আধারে হয়েছিল অবস্থান। তার আগমন পৃথিবীকে জানিয়ে দিয়েছিল সু-প্রভাত। তার ছিল তুল তুলে তনু মায়াময় চেহারা শান্ত নিবিড় চাহনি অধর প্রকল্পিত হাসিময় মুক্তা ঝড়া বদন যেন বাংলার আকাশে এক নবচন্দ্র। আকাশের দোলনায় সিতারায় বিছানার চাঁদ যেমন পূর্ণতা পায় তেমনি ভাবে বড় হতে থাকেন হযরত শাহ সুফি মোজাম্মিল আলী (রহঃ)। তিনি ছিলেন ”খোদাভীরু” কালজয়ী আধ্যাত্বিক দরবেশ নির্জন জঙ্গলেও একা সময় কাটাতে পছন্দ করতেন তিনি। হযরত শাহ্ সুফি মোজাম্মিল আলী (রহঃ) পবিত্র কোরআন শিখেন তার নিজ গ্রামের মক্তবে। তার উস্তাদ ছিলেন মাওলানা মসরফ আলী ও আমানতপুর সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে লেখাপড়া করেন। প্রাথমিক শিক্ষা লাভ করে তিনি নুরুল্লাহপুর দাখিল মাদ্রাসায় ভর্তি হন। সেখান থেকে তিনি সুনামের সাথে দাখিল ও মাধ্যমিক শিক্ষা অর্জন করেন। নুরুল্লাহপুর দাখিল মাদ্রাসা সমাপ্ত করে পরে সিলেটের ঐতিহ্যবাহী সেরা ইসলামী বিদ্যানিকেতন সরকারি আলিয়া মাদ্রাসা সিলেট-এ ভর্তি হয়ে মনোযোগ সহকারে লেখাপড়া করেন। শাহ্ সুফি মোজাম্মিল আলী (রহঃ) বর্ণাঢ্য জীবনে কর্ম জীবন যেন এক ইতিহাস। তিনি ছিলেন এক পূণ্যময় কর্মের অধিকারী। জীবনের প্রতিটি মুহুর্ত ছিলেন মগ্ন ধ্যান ধারণা। তার নিকট থেকে ইলমে দ্বীনের মধু আহরণ করেছিল সেই বাগানের অনেক বুলবুল ছাত্ররা। একাধারে যুগের পর যুগ ইলমে দ্বীনের খেদমত দিয়েছিল আঞ্জাম। নুরুল্লাহপুর দাখিল মাদ্রাসার শিক্ষক হিসেবে যোগদান করেন। ৫২টি বছর ইলমে দ্বীনের খেদমত করেছিলেন “সাবিল্লিাহ“ বা আল্লাহর সন্তুষ্টি অর্জনার্থে। কখনো তার পরিশ্রমের পারিশ্রামিক ও মাসিক ভাতা গ্রহণ করেননি। তিনি মহান মনীষীর একমাত্র উদ্দেশ্য ছিল আল্লাহর ওয়াস্তে ভাল কাজ করা। তিনি কখনও দুনিয়ার সামান্য টাকা পয়সা পরোয়া করেনি। টাকা পয়সা সবকিছু তার নিকট ছিল তুচ্ছ। তিনি নদীর পাড়ে তার নিজ হাতে তৈরি করেন একখানা ইবাদতখানা। এখানে বসবাস করতেন। নদীর সাথে কী যেন স্নেহ মমতা ছিল তা বুঝা মুশকিল। জনশ্রæতি রয়েছে নদীর কলতানে, ঢেউয়ের তালে তালে এবং তার স্নিগ্ধ বাতাসের সাথে ছিল আত্মীয়তার সম্পর্ক। তিনি সব সময় নদীর পাশে সময় অতিবাহিত করতে পছন্দ করতেন। তিনি প্রচন্ড শীতের দিনেও অতিবাহিত করতে পছন্দ করতেন এবং সাতার কাটতেন। গভীর রাতে তাকে নদীতে সাতার কাটতে দেখা যেত। এই অলৌকিক দরবেশ অলির জীবন ছিল ইলমে দ্বীনের খেদমতে নিবেদিত প্রাণ। দক্ষতার সাথে ছাত্রদের পাঠদান করতেন। ঘন্টার পর ঘন্টা পানির নিচে বসবাস করতেন। খিজির (অঃ) এর সাথে তার সাক্ষাৎ হয়েছে বলিয়াও ধারণা করা হয়। এই অলৌকিক অলির জীবন ছিল ইলমে দ্বীনের খেদমতে নিবেদিত প্রাণ। দক্ষতার সাথে ছাত্রদের পাঠদান করতেন। তার সংস্পর্শে স্নেহ মমতায় অনেক ছাত্রদের ভবিষ্যৎ হয়েছিল আলোকজ্জ্বল। তিনি প্রায় গুণ গুণ ভ্রমরের আওয়াজে ফাঁর্সি ভাষায় একটি শের আবৃত্তি করেছিলেন। যার শ্রæতি মধুর আওয়াজ আজও রয়েছে দৃশ্যমান।
“সরফি ইয়ারা মা গর্ষে ছুছগা
নাহয়ি ইয়ারা মগর্তে বাসদ চুশা-হা।।”
এই ফাঁর্সি শের বলে ছাত্র-ছাত্রীদেরকে ইলমুছ ছরফ এর জ্ঞান অর্জনের জন্য উৎসাহ উদ্দীপনা জাগিয়ে তুলেন। এই মনীষী যতদিন এ পৃথিবীতে ছিলেন, ততদিন আল্লাহ তায়ালা এবং তার রাসূল (সৎ) এর সন্তুষ্টি অর্জনের জন্য খেদমত আঞ্জাম দিয়েছিলেন ইলমে দ্বীনের। তিনি ছিলেন একজন নিঃস্বার্থ কর্মবীর। মসজিদ এবং মাদ্রাসার প্রতি অগাধ প্রেম-প্রীতি ভালোবাসা। জীবনের শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করার পূর্বে অনেক অর্থ ব্যয় করে নিজ হাতে তৈরি করেছেন প্রভূর ইবাদতখানা মসজিদ। জীবনের প্রতিটি বসন্ত কেটেছে জনকল্যাণমূলক কাজের মাধ্যমে। হযরত শাহ্ সুফি মোজাম্মিল আলী (রহঃ) বৃহত্তর সিলেটের নামকরা ইসলামী দার্শনিক ব্যক্তিত্বদের চোখে অশ্রæ, অশ্রæভেজা হাজার হাজার আলেম ওলমা, ভক্তবৃন্দদের চোখে অজানা-অচেনা চোখে জল। কারো কান্না কে থামাবে? সবাই যে হারিয়ে ফেলেছেন। নির্বাক দৃষ্টিতে একে অপরের দিকে থাকাচ্ছেন। ক্ষণজন্মা ইসলামী আধ্যাত্বিক ব্যক্তিত্বকে হারানো বেদনায় সবাই শোকাহত। আজ আর আমাদের মাঝে বিদ্যামান নেই। তবে চির অশ্লান রয়েছে তার জীবনের সমস্ত কীর্তিকলাপ। তিনি এমন জীবন গঠন করেছিলেন, যার প্রেম-প্রীতি ভালোবাসা আজীবন মানুষের অন্তরে রেখেছেন বিদ্যমান।
“এমন জীবন তুমি করিবে গঠন
মরিলে হাসিবে তুমি, কাঁদিবে ভূবন”
হযরত শাহ সুফি মোজ্জামিল আলী (রহঃ) ছিলেন খোদাভীরু, দীপ্ত শিখা, প্রেম তার অন্তরে ছিল সদা বিদ্যমান। এ প্রেমের কারণে বিবাহ শাদীর প্রতি ছিলেন অনাসিক্ত। তবুও রাসূলের সুন্নাত ও তার আহলে মুহিব্বিনদের অনুরোধে জীবনের শেষ প্রান্তে এসে এক বিধবা মহিলা সৈয়দুন নেছার সাথে ১৯৯০ সালে বিবাহ বন্ধনে আবদ্ধ হন। তিনি উপজেলার কালারুকা ইউনিয়নের রায়সন্তোষপুর গ্রামের এক মুসলিম পরিবারের মরহুম সাদক মামন এর অষ্টম কন্যা কে বিয়ে করেন। সৈয়দুন নেছা ছিলেন একজন বন্ধ্যা নারী। যার গর্ভে কোন গর্ভজাত সন্তান হয় নি।
নদীর নিচে তলিয়ে যাওয়া গরু ভেসে উঠল :
অবাক করা কান্ড। সুরমা নদীর নিচে তলিয়ে যাওয়া গরুটি পানির উপরে ভেসে উঠল। ছাতক ও সিলেটের সদর উপজেলার সুরমা নদীতে পারাপারের সময় কয়েকটি গরুর মধ্যে একটি গরু পানির নীচে তলিয়ে যায়। ৩/৪ দিন পর হযরত শাহ্ সুফি মোজাম্মিল আলী (রহঃ) নুরুল্লাহপুর বাজারস’ সুরমা নদীর পাশে হুজরা খানায় গিয়ে সুফি সাহেবকে ঘটনাটি খুলে বলেন এবং সুফি সাহেব শুনে নদীতে নেমে অজু করলেন এবং ধীরে ধীরে নদীর মধ্যে নামতে শুরু করলেন। তখন হযরত শাহ্ সুফি মোজাম্মিল আলী (রহঃ) কোমর পর্যন্ত নদীর পানিতে নামলেন তখনি তাৎক্ষনিকভাবে নদীর নীচে তলিয়ে যাওয়া গরুটি জীবন্ত অবস্থায় ভেসে উঠল। এমনকি গরুর বাড়ির দিকে রওয়ানা হয়। এই কান্ড দেখে সবাই অবাক হলেন।
বিলে ছেলে নিখোঁজ – সুরমা নদীতে লাশ উদ্ধার :
সুনামগঞ্জ জেলার দোয়ারা বাজার উপজেলার গ্রামের একটি বিলে মাছ ধরতে গিয়ে অল্প পানিতে নিখোঁজ হয় একটি ছেলে। ঐ বিলের পানির মধ্যে সন্ধান করে নিখোঁজ ছেলেটিকে খোজে পায় নি। ব্যাপক অনুসন্ধান করে নিখোঁজ ছেলেটির সন্ধান পায়নি। এ সময় হযরত শাহ্ সুফি মোজাম্মিল আলী (রহঃ) ঐ এলাকায় আবদুর রশিদ এর বাড়িতে সুফি সাহেব দাওয়াতে এসেছেন। তারা সবাই সুফি সাহেবের শরনাপন্ন হন এবং সেই নিখোঁজ ছেলেটির ঘটনা বর্ণনা করে সুফি সাহেব সহ সবাই মিলে দোয়া করার জন্য অনুরোধ করেন। তখন হযরত শাহ্ সুফি মোজাম্মিল আলী (রহঃ) বলেন আপনারা তাৎক্ষনিক একটা শিরনি করে লোকজনের মধ্যে বিতরণ করে দেয়ার জন্য। তারা তার কথা মতো শিরনি আদায় করে দেয়ার পর সুফি সাহেব বলেছেন নিখোঁজ ছেলেটির মরদেহ বা লাশ তিন দিন পর বাভনগাঁও সুরমা নদীর বাঁকে পাওয়া যাবে। হযরত শাহ্ সুফি মোজাম্মিল আলী (রহঃ) এর কথা মতো সত্যিই তিন দিন পর নিখোঁজ ছেলেটির মরদেহ লাশ পাওয়া গেল সুরমা নদীতে।
ঔষধ ছাড়া রোগ মুক্ত :
সুনামগঞ্জ জেলার জগন্নাথপুর উপজেলার পূর্ব বুদরাইল গ্রামের জিল্লুর রহমান বলেন আমার শরীরে মারাত্মক অসুখ হল। আমাকে সিলেটের হাসপাতালের ডাক্তার বলেন হৃদরোগের মারাত্মক সমস্যা রয়েছে। ডাক্তারের কথা শুনে আমি মহা চিন্তায় পড়ে যাই। পৃথিবীতে যতদিন বাঁচবে নিয়মিত ঔষধ সেবন করতে হবে। ডাক্তারের কথা মতো দীর্ঘদিন ঔষধ সেবন করে আমার অসুখ কমেনি। শেষ পর্যন্ত হযরত শাহ্ সুফি মোজাম্মিল আলী (রহঃ) এর শরনাপন্ন হয়ে বললাম স্যাব, আমি ঔষধ সেবন করতে করতে বিরক্তবোধ করছি। আর আমি ঔষধ সেবন করতে পারব না। তার কথা শুনে সুফি সাহেব বলেন আর ঔষধ সেবন করতে হবে না। আল্লাহর কাছে দোয়া করুন। ঔষধ সেবন ছাড়াই যেন আল্লাহ তায়ালা এ রোগ থেকে শিফা করে দেন। এমনকি আমি আজ পর্যন্ত ঔষধ সেবন করিনি।
বাইয়াত ও কারামত :
নুরুল্লাহপুর গ্রামে প্রয়াত মুফতি আবুল হাসান আব্দুল্লাহ বলেন- হযরত শাহ্ সুফি মোজাম্মিল আলী (রহঃ) কোন বুজুর্গ ব্যক্তির নিকট থেকে বাইয়াত গ্রহণ করেছেন কি না? তা জানা যায় নি। তবে তার বাইয়াত গ্রহণ গ্রহণের তিনি নিজেই প্রায় সময় বলতেন। তিনি ব্যতীত ছাত্রদের নিকট একদিন বললেন যে, তিনি বাইয়াত গ্রহণ করার জন্য প্রথমে গোলচন্দ বাজারে নিকটস্থ সিরাজপুর কাজী বাড়ি সাহেবের নিকট যান। কিন্তু কাজী বাড়ির ছাহেব ক্বিবলা হযরত শাহ্ সুফি মোজাম্মিল আলী (রহঃ) কে বাইয়াত করান নি। তারপর হযরত ফতেহপুর সাহেব ক্বিবলা (রহঃ)-এর দববারে যান। সেখানে তিনি কিছুদিন অবস্থান করার পর চলে আসেন। অতঃপর তিনি নিজেই বর্ণনা করেন যে- হযরত ফতেহপূরী ছাহেব ক্বিবলার দরবার থেকে প্রত্যাবর্তন করে ব্যথাতুর হৃদয়ে চলে যাই হাদীসে বাঙ্গাল হযরত শাহজালাল ইয়ামনি (রহঃ) এর দরগাতে গিয়ে তার প্রেমে বিভোর হয়ে অনেক কান্নাকাটি করতে লাগলাম এবং আধ্যাত্বিক ভাবে আমি তাঁকে মুর্শিদ হিসেবে মেনে নিলাম। প্রয়াত কাজী মাওলানা আবুল হাসান আব্দুল্লাহ বলেন- শাহ্ সুফি মোজাম্মিল আলী (রহঃ) প্রায় সময় বলতেন আমার মুর্শিদ হলেন আমার বাদশা অর্থ্যাৎ হযরত শাহজালাল ইয়ামনি (রহঃ)। তাইতো জীবনে তিনি হযরত শাহজালাল ইয়ামনি (রহঃ)-কে নাম ধরে সম্বোধন করেন নি। বরং সর্বদা বাদশা বলে সম্বোধন করতেন।
জানাযা ও কারামত :
ঝাঁকে ঝাঁকে জালালী কবুতর কিছমিছ করে কান্নার সুর অচেনা হাজার হাজার মানুষের ঢল। সবার চোখে জল। আকাশে বাতাসে হাহাকারের আর্তনাদ। সাদা টুপি, সাদা জামায় গোটা এলাকায় মুখরিত হয়ে উঠল। শাহজালাল ইয়ামনি (রহঃ) এর জালালী কবুতরগুলো সবার উপরে ছায়া ছড়িয়ে দিচ্ছে, যেন জালালী কবুতরের ঝাঁক। হাজার হাজার কবুতর জানাযার শেষে কোথায় যেন অতল গভীরে হারিয়ে যায়। যা কেহ বলতে পারেনি। এসময় সৌরভে একটি চমৎকার সু-গন্ধ ছিল।
নুরুল্লাহপুর গ্রামের প্রয়াত মুফতি মাওলানা কাজী আবুল হাসান মোহাম্মদ আব্দুল্লাহ বলেন- শাহ্ সুফি মোজাম্মিল আলী (রহঃ) এর জানাযায় শুধু মানুষ ছিলেন তা কেউ বলতে পারেবেন না। গুন গুনে কান্না ও আর্তনাদের সুর কানে আসে। পাখিরা ঝাঁক করে এসেছিল ঘটনাস্থলে। এতো মানুষের ঢল ও জামাত দৃশ্য অবাক হয়ে গেল। হাজার হাজার মানুষের সমাগম হয়েছিল। এখানে জানাযার শেষে কে? কোথায় চলে গেছেন তার কোনো হদিস পাওয়া গেল না। তাও একটি কারামত। কালারুকা লতিফিয়া দাখিল মাদ্রাসার সুপার মাওলানা মাহবুব রহমান তাজুল বলেন একাধিক অন্যান্য লোকদের কাছ থেকে জানা যায় হযরত শাহ্ সুফি মোজাম্মিল আলী (রহঃ) এর জানাযায় হযরত শাহজালাল ইয়ামনি (রঃ) জালালী কবুতর শত শত ঝাক এসেছিল। তারা স্বচক্ষে প্রত্যক্ষদর্শী ছিলেন। তাও যেন একটি কারামত। শাহ্ সুফি মোজাম্মিল আলী (রহঃ)এর কারামত অসংখ্য অগনিত রয়েছে যা বলে শেষ করা যাবে না।
হযরত শাহ জালাল ইয়ামনি (রহঃ) সাথে সুফি আত্মার সম্পর্ক :
হযরত শাহ্ জালাল ইয়ামনি (রহঃ) এর সাথে হযরত শাহ্ সুফি মোজাম্মিল আলী (রহঃ) এর গভীর আত্মার সম্পর্ক ছিল বলে কঠোর পরিশ্রম এবং প্রচুর অর্থ ব্যয় করে খোদাভীরু প্রেমের নিদর্শন স্বরূপ নির্মাণ করেন। হঠাৎ সুফি ছাহেব বলে উঠেন- আমি আমার বাদশার দরবারে যাব অর্থাৎ হযরত শাহজালাল (রহঃ) এর দরগা শরীফ সিলেট শহরে যান। সেখান থেকে ফিরেই হযরত শাহজালাল ইয়ামনি (রহঃ) নাম অনুসরণে মসজিদটির নাম করণ করা হয়। তিনি ছিলেন হযরত শাহজালাল ইয়ামনি (রহঃ) এর আত্মার আত্মীয়। তার প্রতিটি কাজ কর্মে তিনি হযরত শাহজালাল ইয়ামনি (রহঃ) অনুসরণ করতেন। শাহজালালের সাথে যেন সুফি সাহেব আত্মা একে বারেই বিলীন হয়ে গেছে। শাহজালাল ইয়ামনি (রহঃ) এর দরগাহ শরীফ থেকে সুফি ছাহেব ফিরে এসে তার ভক্তবৃন্দ কে বললেন- আমার বাদশা হযরত শাহজালাল ইয়ামনি (রহঃ) এর নামে মসজিদ হবে। সুফি ছাহেবের কথা সবাই ঐক্যবদ্ধভাবে মেনে নেন এবং মসজিদের নামকরণ করলেন হযরত শাহজালাল ইয়ামনি (রহঃ) মসজিদ নামে। হযরত শাহ্ সুফি মোজাম্মিল আলী (রহঃ) এর কতটুকু ভালোবাসা ছিল হযরত শাহজালাল ইয়ামনি (রহঃ) এর জন্য তার বাস্তব প্রমাণ মসজিদের নাম করণ তা আজো বিদ্যমান আছে। হযরত শাহ্ জালাল ইয়ামনি (রহঃ) এর সাথে যে গভীর সম্পর্ক ছিল মসজিদের নাম করণে আজীবন বেঁচে থাকবে। কেয়ামত পর্যন্ত এ শ্রদ্ধা, ভক্তি, প্রেম, প্রীতি, থাকবে চিরদিন।
মসজিদের খতিব নির্বাচন :
হযরত শাহ্ সুফি মোজাম্মিল আলী (রহঃ) তার প্রতিষ্ঠিত হযরত শাহ্ জালাল ইয়ামনি (রহঃ) জামে মসজিদ নির্মাণ পরে ইমাম নির্বাচন করেন ক্বারী আব্দুল বাকী প্রতি জু’মার দিনে হাজার হাজার মুসল্লির আগমণ ঘটে। মুসল্লিদের আগমণে লোকারণ্য তার প্রতিষ্ঠিত মসজিদ এর মাঠ। তখন চিন্তা করলেন তার মসজিদে প্রতি জুমার দিনের জন্য একজন যোগ্য খতিব নির্বাচন করতে হবে। হযরত শাহ্ সুফি মোজাম্মিল আলী (রহঃ) ভক্তবৃন্দ অভিমত শ্রবণ করার পর তার ভক্তবৃন্দরা বিভিন্ন উলামায়ে কেরামের নাম বললেন। তাদের প্রস্তাবিত নাম শুনার পর কোন কিছুতেই রাজি হননি। শেষ পর্যন্ত হযরত শাহ্ সুফি মোজাম্মিল আলী (রহঃ) বললেন- আমার মসজিদে এমন একজন খতিব নির্বাচন করবো যিনি অধমের ন্যায় দুনিয়া বিবাগী। দুনিয়ার সম্পদের প্রতি তার কোন প্রেম-প্রীতি নেই এবং আল্লাহ তায়ালার রেজামন্দি হাসিলের যেন তিনি সর্বদা পূণ্য কাজে অগ্রগামি। এমন কি সব কথা ব্যক্ত করার পর তিনি বললেন হাদীস জগতের বৃহত্তর সিলেটের উজ্জ্বল নক্ষত্র, শায়খুল হাদীস, সৎপুর দারুল হাদীস কামিল মাদ্রাসার সম্মানিত শায়েখ মুহাদ্দিস আল্লামা আব্দুল হাই (ছাতকী হুজুর) এর নাম শুনে সবাই একবাক্যে মেনে নেন এবং উপযুক্ত খতিব পেয়ে সকল মুসল্লিরা আনন্দিত হয়ে যান। এ খতিব বৃহত্তর সিলেটের হাজার হাজার মুহাদ্দিস সৃষ্টিকারী ওস্তাদ। হাদিস জগতে উজ্জ্বল নক্ষত্র।
মাদ্রাসার নামকরণ :
হযরত শাহ্ সুফি মোজাম্মিল আলী (রহঃ) এর ভক্ত আশিকানরা মাদ্রাসা প্রতিষ্ঠা করেন। সেই প্রতিষ্ঠিত মাদ্রাসার নামকরণ তার নিজ নামে করেন হযরত শাহ্ সুফি মোজাম্মিল আলী (রহঃ) দাখিল মাদ্রাসা। সেই মাদ্রাসা হযরত শাহ্ সুফি মোজাম্মিল আলী (রহঃ) এর মাজারের সন্নিকটে অবস্থিত।
সুফি নগর নামকরণ :
হযরত শাহ্ সুফি মোজাম্মিল আলী (রহঃ) যখন ইন্তেকাল করেন তখন তার ভক্ত আশিকানরা তাকে তার প্রতিষ্ঠিত মসজিদের পাশে কবর দেন। ইতিহাসের পাতা খুললে দেখা যায় বুযুর্গানে দ্বীনের কবরগুলো মসজিদ এর পাশেই রয়েছে। তেমনিভাবে হযরত শাহ্ সুফি মোজাম্মিল আলী (রহঃ) ভক্ত আশিকানরা তাকে মসজিদের পাশে দাফন করে ক্লান্ত হননি বরং তারা স্মৃতি বিজড়িত এলাকার নাম করণ তার নামেই করেছেন। যা সুফিনগর নামে সর্ব মহলের নামে পরিচিত। সকল শ্রেণির মানুষের কাছে শ্রদ্ধাপাত্র হিসেবে সু-পরিচিত। ৩৬০ আউলিয়ার পূণ্যভূমি বৃহত্তর সিলেটর আধ্যাত্বিক রাজধানী হিসেবে সিলেট সর্বত্র পরিচিত ও পরবর্তীকালে ইসলাম প্রচারের আস্তানা সৃষ্টি করে গেছেন। খ্যাতনামা আধ্যাত্বিক দরবেশ উপ-মহাদেশের মনীষী হযরত শাহ্ জালাল ইয়ামনি (রহঃ) সূত্র ধরে হযরত শাহ্ সুফি মোজাম্মিল আলী (রহঃ) সুফি ছাহেব সিলেটে হযরত শাহ্ জালাল ইয়ামনি (রহঃ) এর ইশারা পেয়ে সিলেট শহর ছেড়ে সুনামগঞ্জ জেলার ছাতক উপজেলাতে এসে কর্মতি স্থাপন করেন। তাই সুনামগঞ্জ ও ছাতক উপজেলা সদরের সুফি সাধকদের প্রবেশদ্বার রূপ চিরকাল চিহ্নিত হয়ে থাকবে। ছাতক শহর প্রাকৃতিক কমলা লেবু, মৌ, মৌ, গন্ধে পাথর, বালু, গ্যাস, চুনাপাথর, আকাশে আজব গাড়ি, এশিয়ার ঐতিহ্যবাহী সিমেন্ট শিল্প সুরমা লাফার্জ সিমেন্ট কারখানা, ডায়মন্ড সিমেন্ট কারখানা নদীর দু-পাড়ে সারি সারি চুনা শিল্পের কারখানা ও সবুজ পাহাড় ঘেরা নির্জন পরিবেশ মন্ডিত এলাকা। এই শহরে শত শত অলি, দরবেশ, মরমী সাধকের সাধনায় ভূমি বিশ্বের দরবারে সু-পরিচিত। ইসলামী দার্শনিক হিসেবে বিশ্বের উজ্জ্বল নক্ষত্র দেওয়ান মোহাম্মদ আজরফ জাতীয় অধ্যাপক ও ফকির আফজল শাহ ওরফে আরমান আলী (রহঃ) সুফিবাদ জাগতিক আধ্যাত্বিক হিসেবে বিশ্বের মানচিত্রে ফার্সি, উর্দু, আরবি ও ইংরেজি মরমী কিংবা দার্শনিক হিসেবে লোক সাহিত্যের বিশাল ভান্ডার রেখে গেছেন। তিনি উপ-মহাদেশের অন্যতম দার্শনিক হিসেবে ছিলেন এবং আমাদের দর্শন আকাশে দ্রæবতারা হয়ে আজীবন বেচেঁ থাকবে স্মৃতির পাতায়। অলি, দরবেশ, ফকির, সুফি সাধকের এই প্রকৃতি পরিবেশ যেন রাব্বুল আলামীন শুধু সুফীদের আধ্যাত্বিক আত্মিক ক্রিয়াকালের জন্য পথ প্রদর্শক হিসেবে বিশেষভাবে তৈরি করেছেন। সিলেটের আধ্যাত্বিক এর সাথে ছাতক উপজেলার সুফি সাধকদের চমৎকার আধ্যাত্বিক ও জাগতিক যোগসূত্র লক্ষ্যনীয়। হযরত শাহ সুফি মোজ্জাম্মিল আলী (রহঃ) তিনি ইসমে মারিফতে দীক্ষা গ্রহণ করলেন। সেই জ্যোর্তিময় হযরত শাহ জালাল ইয়ামনি (রঃ) সান্নিধ্য পেয়ে সুফি সাহেব অত্যন্ত গৌরবান্তিত হলেন। অল্প কালের মধ্যে তিনি সুফিদের সহচর থেকে এলমে বাতেন শাস্ত্রে চরম উৎকর্ষতা লাভ করে অফুরন্ত নেয়ামত হাসিল করলেন। তার অন্তর আল্লাহ প্রেমের জোয়ারে পরিপূর্ণ এবং রাব্বুল আলামীনের সাথে মিলনাকাঙ্কায় মন তাঁর উম্মুখ। এমন প্রেমাস্পদের সন্ধান পেয়ে সুফি সাহেব হাসি খুশিতে এলাকার ফুল ফুটে উঠে। ফুলের সৌরভ এলাকায় ছড়িয়ে পড়ে নিরবে। ফুলের সৌরভে সুগন্ধে মাতোয়ারা এবং লোক লোকালয়ে মিলন মেলায় পরিণত হয়েছে। ঝাওয়া নদীর তীরে একটি খানকা স্থাপন করে নিরবে ইসলাম প্রচারে আত্মনিয়োগ করেন। সুনামগঞ্জ জেলার আধ্যাত্বিক সিংহ পুরুষ ফকির আফজল শাহ, হেকিম শাহ, দার্শনিক দেওয়ান আজরফ, আজিম শাহ, ছাবাল আলী শাহ, শাহ সুফি আনাছ আলী, দুর্ব্বিন শাহ, মান উল্লাহ শাহ, হাসিম শাহ, মুন শাহ, গোলজার শাহ, খোদা বখস শাহ, সুফি সাহেব ছিলেন। হযরত শাহ্ সুফি মোজাম্মিল আলী (রহঃ) যেখানে ছিল গভীর জলাশয় সেই জলাশয়ে মাটি ভরাট করে ঝাওয়া খাড়া নামক স্থানে নিরিবিলি পরিবেশ নির্বাচন করে তিনি খানকাহ স্থাপন করেন। পরবর্তীকালে ঐ স্থান খানকায়ে ’’সুফিনগর” নামে প্রসিদ্ধি লাভ করে। ছাতক উপজেলার সহজ সরল প্রাণের সাধারণ মানুষ তখন একজন ঐশ্বরিক ত্রাণকর্তার প্রয়োজন অনুভব করেছিলেন। এদিকে হযরত শাহ্ সুফি মোজাম্মিল আলী (রহঃ) লোক চক্ষুর অন্তরালে আত্মিক কার্যকলাপ চালিয়ে যেতে থাকেন। তিনি সাধারণ লোকের মন জয় করতে পেরেছিলেন তার নম্র ব্যবহার পরম বৈষু গুণ এবং মৌনতার দ্বারা। তাই তাঁকে স্থানীয় বাসিন্দারা সমীহ তার সমস্ত গুণাবলীর জলরাশি, ঘন ঘন ডাকাতি, নৌকাডুবীসহ নানা অপরাধমূলক কর্মকান্ড ঘটতো। সেখানে একটি খানকাহ স্থাপন করে নিরবে প্রভুর আরাধনা করতেন। হযরত শাহ্ সুফি মোজাম্মিল আলী (রহঃ) তখন নিরব আধারত ছিলো তার সহচর। মৌনতা সরলতা এবং বিশস্ততার কারণে স্থানীয় জনসাধারণের কাছে তিনি ছিলেন অত্যন্ত দক্ষ এবং নিরলস কর্মী। কোন প্রকারভেদ ছিলো না। ইসলামের সাম্যতার প্রতি শ্রদ্ধা জানিয়ে ছিলেন আধ্যাত্বিক জগতে এতো বড় সুফি হয়েও তিনি প্রার্থিব প্রতিপ্রত্তির মোহে আচ্ছন্ন হন নি। কর্ম জীবন তাঁকে সুন্নতের আয়বরী করতে সাহায্য করেছে। একজন বেলায়ত প্রাপ্ত সুফি হয়ে চাকুরী গ্রহণ করে তিনি সুন্নতের প্রতি অসীম ভালোবাসা দেখিয়েছেন। সমাজ প্রতিদের ধন দৌলতের গর্বকে তিনি আল্লাহ পাকের ইচ্ছায় ঐশী ক্ষমতার বলে অলৌকিকভাবে অসংখ্য কারামত দেখিয়েছেন। প্রায় সময় তিনি নিরবতা অবলম্বন করতেন বলে তার চরিত্রের এক বিরাট অধ্যায় জ্ঞাত রয়ে গেছে। নিজে কোন প্রকার প্রচারনাকে তিনি প্রাণভরে ঘৃনা করতেন। তার কাছে আদবের অত্যন্ত সামাদর ছিলো, কিন্তু বে-আদবকে কখনো তিনি প্রশ্রয় দিতেন না। ফকির আফজল শাহ (রহঃ), শাহ্ সুফি মোজাম্মিল আলী (রহঃ) এর আগমণে সুনামগঞ্জ তথা ছাতকবাসী হলো ধন্য মুসলমান, হিন্দু, বৌদ্ধ, খ্রিস্টান, উপজাতী সহ সকলেই তার সমাধীতে মনের আকুল, নিবেদন করে ফকির আফজল শাহ (রহঃ), হযরত শাহ্ সুফি মোজাম্মিল আলী (রহঃ) সাধারণ সুফি সাহেবের গন্ডি পেরিয়ে এখন একজন ঐশ্বরিক ত্রাণকর্তা। তার সমাধিতে খুশদুজার রঙ্গিন গিলাফ মোড়ানো মকারার সৌরভে মাতোয়ারা হয়েছে ভক্তকুল। তিনি যতবেশি প্রেমিক তত বেশি রূহানি ফয়েজ লাভ করেন। প্রিয়জনের মৃত্যু বার্ষিকীতে যেমন প্রেমিক প্রচার ও প্রেমিক পাগল পায় দিশেহারা হয়ে পড়েন। তেমনি ফকির আফজল শাহ (রহঃ), হযরত শাহ্ সুফি মোজাম্মিল আলী (রহঃ)-এর ভক্তবৃন্দ তার পবিত্র ওরশ শরীফে এসে অসীম শ্রদ্ধায় রোদন করতে থাকেন।
এমন একদিন ছিলো যেদিন তিনি সুফি ছাহেবের পাখা টেনে দিনাতিপাত করতেন। আজ তিনি অসহায় দুঃখ পীড়িত ভক্তবৃন্দের শান্তির পাখা টেনে স্বর্গীয় সুখদান করে চলেছেন।
জুতা কখনো ব্যবহার করেনি :
হযরত শাহ্ সুফি মোজাম্মিল আলী (রহঃ) জীবনে কখনো জুতা ব্যবহার করেনি। শুধু পা ধোয়ার সময় ব্যবহার করতেন বাড়ীতে। বাড়ীর বাইরের কোথায় গেলে খালি পায়ে চলে যেতেন তিনি। তার বাদশা হযরত শাহজালাল ইয়ামনি (রহঃ) পবিত্র ভুমি অপবিত্র হবে বলে জীবনে কখনো জুতা ব্যবহার করেনি। কিন্তু প্রচন্ড ঠান্ডার দিন রাতে ও জুতা পায়ে লাগাননি তিনি।
বাদশা দরবারে হাজির :
হযরত শাহজালাল ইয়ামনি (রহঃ) সিলেটের মাজারের প্রতি সপ্তাহ একদিন হাজিরা দিতেন হযরত শাহ সুফি মোজ্জামিল আলী (রহঃ)। তিনি প্রতি শুত্রæবার জুম্মার নামাজের এর আগে হযরত শাহজালাল (রহঃ) মাজার এর পাশে ধ্যান মগ্নে বিভোর থাকেন। জুমার নামাজ পড়ে কোথায় যেন হারিয়ে যেত। কেউ তাকে খোজে পেতেন না। আছর নামাজ এর সময় যে কোনো মজজিদের সামনে তাকে পাওয়া যেত। তিনি জীবনে কখনো হযরত শাহজালাল (রহঃ) ইয়ামনি কে নাম ধরে ডাকেনি। সব সময় তিনি আমার বাদশা বলে ডাকতেন। অবশেষে তিনি তার বাদশা হযরত শাহজালাল (রহঃ) ইয়ামনিকে সম্মানীত স্থানে বসান। তার বাদশার নামেই মজসিদ নির্মাণ করে গেছেন।
দারুল ক্বিরাত প্রতিষ্ঠা করে আধ্যাত্বিক জগতের অলিকুল শিরোমনি শামসুল উলামা আল্লামা ফুলতলী (রহঃ)১৯৪০ সালে এ বাংলার জমিনে দারুল ক্বিরাত ও কোরান শিক্ষার কেন্দ্র প্রতিষ্ঠা করেন। হযরত শাহ সুফি মোজ্জামিল আলী (রহঃ) তার প্রতিষ্ঠিত জামে মসজিদে প্রতি শুত্রæবার জুমার দিনে দারুল ক্বিরাত শিক্ষার অনুমোদন এর জন্য এই মসজিদ ইমাম ক্বারী আব্দুল বাকীকে নিজ হাতে নাজিম নিয়োগ করে সুফি সাহেব তাকে ফুলতলী পাঠান। সেখানে গিয়ে দারুল ক্বিরাত শিক্ষার অনুমোদন ফুলতলী থেকে নিয়ে আসে ক্বারী আব্দুল বাকী। তখন থেকে তার প্রতিষ্ঠিত জামে মসজিদে দারুল ক্বিরাত শিক্ষা কেন্দ্র চালু করেছিলেন। তার প্রিয় ইমাম ক্বারী আব্দুল বাকীর মাধ্যমে দারুল ক্বিরাত চলছে একান্ত নিষ্টার সাথে ।
সুরমা নদী থেকে চাবি উদ্ধার !
হযরত শাহ সুফি মোজ্জামিল আলী (রহঃ) নুরুল্লাপুর মাদ্রাসা থেকে সিলেটের আলীনগর গ্রামে যাওয়ার পথে সুরমা নদী খেয়া পারাপাড় হচ্ছেন। এ সময় হঠাৎ করে তার পকেট থেকে এক জোটা চাবি সুরমা নদীতে পড়ে গেছে। তখন হযরত শাহ সুফি মোজ্জামিল আলী (রহঃ) মনে মনে গুণ করে পড়তে লাগলেন। তার পর সুফি সাহেব আলী নগর গ্রামের মন্তাজ আলীর লজিং বাড়ীতে অবস্থান নেন। তখন তিনি রুমে টুকে গুন গুন করে পড়তে লাগার কিছু সময় পর ঘরে ভিতরে চাবির জোটা পাওয়া গেল।
মৃত্যুর পর মসজিদের প্রতি সু-নজর !
হযরত শাহ সুফি মোজ্জামিল আলী (রহঃ) আমাদের মাঝে নেই। হাজার হাজার ভক্তবৃন্দের সমাগম ঘটে। লোক চক্ষুর আড়ালে লোকান্তরিত হলে সত্যি একটি বাস্তব ঘটনার পুনরায় ঘটলো যে, তিনি মৃত্যুর পর তার প্রতিষ্ঠিত মসজিদের প্রতি সু-নজরদারী করেছেন। এ সর্ম্পকে একটি ঘটনা বর্ণনা দিলেন তার মসজিদের ইমাম ক্বারী আব্দুল বাকীর। এ মাজারের দোয়া দুরুদ করতে এসেছেন জনৈক মহিলা। অতঃপর তিনি মাজার শরীফ থেকে ভুলত্রæমে টাকা না দিয়ে একটি নাগা মরিচ নিয়ে যান। কয়েক দিন অতিবাহিত হওয়ার পর জনৈক মহিলা একদিন রাতে স্বপ্নে দেখেন হযরত শাহ সুফি মোজ্জামিল আলী (রহঃ) তাকে বলেন হে মহিলা! আমার মসজিদ থেকে তুমি যে নাগা মরিচ এনেছিলেন তার টাকা এখনো দিলে না যে। পরের দিন এই মহিলা নাগা মরিচের টাকা নিয়ে মসজিদে সামনে হাজির হয়ে স্বপ্নের কথা বর্ণনা করে অশ্রæচোখে জল এবং মসজিদ ইমাম ক্বারী আব্দুল বাকীর নিকট মসজিদের নাগা মরিচের টাকা প্রদান করেন।
মসজিদ নির্মাণে সহযোগিতা কারা ছিলেন :
মসজিদ নির্মাণের প্রথম মহিলা হিসেবে সহযোগিতায় ছিলেন লন্ডন প্রবাসী সৈদেরগাঁও ইউনিয়নের বুড়াইরগাঁও গ্রামের জনৈক লন্ডন প্রবাসীর স্ত্রী রোকেয়া বেগম বাপের বাড়ী রায়সন্তোষপুর গ্রামের প্রয়াত হাবিবুর রহমান আমিনের বোন। গলার সোনার হার মসজিদের নামে বরাদ্দ করেন। এর পর আবারো নগদ লাখ টাকা সুফি সাহেব হাতে তুলে দেন। আব্দুল লতিফ মাষ্টার, মনির মিয়া চেয়ারম্যান, সিরাজ মিয়া, আলাউদ্দিন, আব্দুল করিম, ওয়াতির আলী, সালিক মিয়া, হাজী ইলিয়াছ আলী, আলহাজ¦ ফারুক আহমদ প্রমুখ।