সুনামগঞ্জ সরকারি কলেজের শহিদ মিনার গুঁড়িয়ে দেওয়া: ইতিহাসে কুঠারাঘাত নাকি
প্রশাসনিক উদাসীনতা?
রিপোর্ট: আনোয়ার হোসেন রনি
সুনামগঞ্জ, অক্টোবর ২০২৫ —সুনামগঞ্জ সরকারি কলেজ প্রাঙ্গণে ঘটে গেছে এক হৃদয়বিদারক ঘটনা। ভাষা আন্দোলন ও মুক্তিযুদ্ধের গৌরবময় স্মৃতি–বিজড়িত ঐতিহাসিক শহিদ মিনারটি ভেঙে ফেলা হয়েছে। কলেজ কর্তৃপক্ষের সিদ্ধান্তে এই মিনার গুঁড়িয়ে দেওয়ার ঘটনায় ক্ষোভে ফুঁসছে পুরো হাওর জনপদ।
ষাটের দশকে নির্মিত এই শহিদ মিনারটি শুধু একটি স্থাপনা ছিল না—এটি ছিল সময়, ইতিহাস, দেশপ্রেম আর সংস্কৃতির এক অমর প্রতীক। যে মিনার থেকে বহু প্রজন্ম শিখেছে প্রতিবাদ, শিখেছে স্বাধীনতার চেতনা ও মানবতার বার্তা। অথচ সেই ঐতিহাসিক স্থাপনাটি আজ আর নেই।
ভাষা ও মুক্তিযুদ্ধের প্রতীক সেই মিনার ষাটের দশকের শুরুতে, একঝাঁক তরুণ ছাত্রের উদ্যোগে ভাষা আন্দোলনের শহিদদের স্মরণে সুনামগঞ্জ সরকারি কলেজ প্রাঙ্গণে এই শহিদ মিনারটি নির্মিত হয়। পরে মুক্তিযুদ্ধ চলাকালে পাকিস্তানি সেনারা কলেজে আক্রমণ চালালে মিনারটি ক্ষতিগ্রস্ত হয়।
স্বাধীনতার পর কলেজের তরুণ মুক্তিযোদ্ধারা—ছাত্রনেতা গোলাম রব্বানী ও নাসির উদ্দিন চৌধুরীর নেতৃত্বে—আবারো তা সংস্কার ও পুনর্নির্মাণ করেন। শহিদের স্মৃতি, স্বাধীনতার গর্ব আর মুক্ত চিন্তার প্রতীক হিসেবে এই মিনারটি হয়ে ওঠে সুনামগঞ্জের সংস্কৃতিচর্চার কেন্দ্র।প্রতি বছর একুশে ফেব্রুয়ারি থেকে শুরু করে স্বাধীনতা দিবস, বিজয় দিবস, এমনকি সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান—সবই এই মিনারকেন্দ্রিক ছিল। স্থানীয় মানুষ, সাবেক ছাত্র, মুক্তিযোদ্ধা ও সাংস্কৃতিক কর্মীরা একে দেখতেন “আবেগের মন্দির” হিসেবে।অবাক করা সিদ্ধান্ত: গুঁড়িয়ে দেওয়া হলো ঐতিহ্যকিন্তু সেই আবেগের জায়গায় আজ গভীর ক্ষোভ। অভিযোগ উঠেছে—কলেজ কর্তৃপক্ষই নাকি সিদ্ধান্ত নিয়েছেন মিনারটি গুঁড়িয়ে সেখানে “কৃতী ফলক” নির্মাণের।
শিক্ষা প্রকৌশল অধিদপ্তরকে নাকি বলা হয়েছে এখানেই ফলকটি নির্মাণ করতে, যদিও সংস্থাটি প্রস্তাব দিয়েছিল কলেজের প্রবেশদ্বার-সংলগ্ন উত্তরাংশে তা স্থাপন করার। একাধিক শিক্ষক ও সাবেক ছাত্রের দাবি, কলেজের অধ্যক্ষ ও কিছু প্রভাবশালী শিক্ষক এই পরিকল্পনার পেছনে ছিলেন। অথচ দেড় বছর আগেও অধ্যক্ষ রজত কান্তি সোম মানস স্পষ্টভাবে বলেছিলেন—“ভাষা আন্দোলন ও মুক্তিযুদ্ধের স্মৃতি–বিজড়িত শহিদ মিনারের জায়গায় কোনো স্থাপনা হবে না।”
সেই দৃঢ় অবস্থান আজ আর নেই। প্রশ্ন উঠেছে—কী এমন পরিবর্তন ঘটল যে কলেজের ইতিহাসকে মুছে দিতে হলো? প্রকল্প নাকি প্রভাব? অনেকে মনে করছেন, এই ‘কৃতী ফলক’ প্রকল্পের আড়ালে অন্য হিসাব আছে। প্রকল্পের অর্থনৈতিক সুবিধা, ঠিকাদারি প্রভাব কিংবা ‘দেখানোর উন্নয়ন’—এসব কারণেই হয়তো ঐতিহাসিক মিনারটিকে বলি দেওয়া হয়েছে।
স্থানীয় নাগরিক কমিটির এক সদস্য বলেন,
“এটা কোনো উন্নয়ন নয়, এটা ইতিহাস হত্যা। সরকারি তহবিলের নাম করে যেভাবে ঐতিহ্য নষ্ট করা হচ্ছে, তা ক্ষমার অযোগ্য।”অধ্যক্ষ ও শিক্ষকদের ভূমিকা নিয়ে প্রশ্ন ঘটনার পর কলেজ প্রশাসনের ভূমিকা নিয়েও প্রশ্ন তুলছেন সাবেক শিক্ষার্থীরা। কলেজের অভ্যন্তরীণ সূত্র বলছে, অধ্যক্ষ ও কয়েকজন শিক্ষক শিক্ষা প্রকৌশল অধিদপ্তরের কর্মকর্তাদের সরাসরি নির্দেশ দেন শহিদ মিনারটি সরিয়ে ফেলতে।
তবে বিষয়টি নিয়ে কলেজ কর্তৃপক্ষ এখনো কোনো আনুষ্ঠানিক ব্যাখ্যা দেননি। অধ্যক্ষের সঙ্গে যোগাযোগের চেষ্টা করা হলেও তিনি গণমাধ্যমে মন্তব্য করতে রাজি হননি। একজন জ্যেষ্ঠ শিক্ষক নাম প্রকাশ না করার শর্তে বলেন,“আমাদের মধ্যে অনেকেই চেয়েছিলেন নতুন করে স্মারক নির্মাণ হোক, কিন্তু শহিদ মিনার ভেঙে নয়। এটি ভাঙা ভুল সিদ্ধান্ত, এতে কলেজের ভাবমূর্তি ক্ষুণ্ণ হয়েছে।”শহিদ মিনার ভাঙায় ক্ষোভে ফুঁসছে শিক্ষার্থী ও স্থানীয়রা সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে এবং স্থানীয় রাজপথে ইতোমধ্যে প্রতিক্রিয়া দেখা দিয়েছে। কলেজের সাবেক ও বর্তমান শিক্ষার্থীরা
ক্ষোভ প্রকাশ করে বলছেন—“যেখানে দেশের প্রতিটি প্রান্তে শহিদ মিনার সংরক্ষণের উদ্যোগ নেওয়া হচ্ছে, সেখানে সুনামগঞ্জ সরকারি কলেজে তা ভেঙে ফেলা হলো—এ যেন জাতীয় অপমান।”
স্থানীয় সাংস্কৃতিক সংগঠন ও মুক্তিযোদ্ধা সংসদের পক্ষ থেকেও এ ঘটনায় প্রতিবাদ জানানো হয়েছে। তারা বলছেন, “যারা শহিদ মিনার ভেঙেছে, তারা আসলে ইতিহাস ও শহিদদের অবমাননা করেছে।”
ছাত্রদলের স্মারকলিপি ও গণপ্রতিক্রিয়া
আজ (মঙ্গলবার) সুনামগঞ্জ সরকারি কলেজ ছাত্রদল নেতৃবৃন্দ জেলা প্রশাসকের কাছে একটি স্মারকলিপি দিয়েছেন। তারা শহিদ মিনার ভাঙাকে ভাষা আন্দোলন ও মুক্তিযুদ্ধের প্রতি “গণঅবজ্ঞা” হিসেবে আখ্যা দিয়েছেন।
স্মারকলিপিতে তারা দাবি করেছেন—১. ঐতিহাসিক শহিদ মিনারের ধ্বংসে দায়ীদের শনাক্ত করে শাস্তি দিতে হবে।২. দ্রুততম সময়ে আগের নকশায় শহিদ মিনার পুনর্নির্মাণ করতে হবে। ৩. ভবিষ্যতে কলেজের ঐতিহ্যবাহী স্থাপনাগুলো সংরক্ষণের নিশ্চয়তা দিতে হবে।
ছাত্রদল নেতাদের বক্তব্যে স্পষ্ট আবেগ—“এটা শুধু শহিদ মিনার নয়, আমাদের চেতনার প্রতীক। যারা এটি ধ্বংস করেছে, তারা স্বাধীনতার ইতিহাসে কলঙ্কের দাগ লাগিয়েছে।ঐতিহাসিকদের মতামত: এটি জাতীয় সম্পদ ইতিহাসবিদ ও গবেষক ড. মোজাম্মেল হোসেন মনে করেন,
“ষাটের দশকে প্রতিষ্ঠিত এই শহিদ মিনারটি কেবল সুনামগঞ্জের নয়, এটি বাংলাদেশের ভাষা ও মুক্তিযুদ্ধ ইতিহাসের অংশ। একে ধ্বংস করা মানে সাংস্কৃতিক স্মৃতি মুছে ফেলা।” তিনি বলেন, “এই মিনারকে পুনর্নির্মাণ করা শুধু আবেগের দাবি নয়, এটি রাষ্ট্রীয় দায়িত্বও বটে।” সংরক্ষণের বদলে ধ্বংস: প্রশাসনের নীরবতা কেন? এ ঘটনায় শিক্ষা প্রকৌশল অধিদপ্তর কিংবা জেলা প্রশাসনের পক্ষ থেকেও এখনও কোনো তদন্ত ঘোষণা করা হয়নি। প্রশাসনিক নীরবতা জনমনে আরও প্রশ্ন তৈরি করেছে—কেন এই ঐতিহাসিক স্থাপনাটি সংরক্ষণের উদ্যোগ নেওয়া হলো না? কেন এ বিষয়ে কোনো গণশুনানি বা আলোচনার আয়োজন হয়নি? স্থানীয় নাগরিক সমাজের নেতা বলেন,“যদি সংস্কার করতে হতো, সেটি শহিদ মিনার অক্ষত রেখেই করা যেত। কিন্তু তারা সেটিকে ‘গুঁড়িয়ে’ দিয়েছে—এটা রাজনৈতিক উদাসীনতা নয়, এটা চেতনার প্রতি চ্যালেঞ্জ।”.শহিদ মিনার: আবেগ ও আন্দোলনের কেন্দ্রবিন্দু
সুনামগঞ্জ সরকারি কলেজের এই শহিদ মিনার শুধু একুশের স্মৃতি নয়, এটি ছিল প্রতিবাদের অনুপ্রেরণা। ১৯৭১–এর পর থেকে কলেজের ছাত্রছাত্রী, শিক্ষক, সাংস্কৃতিক কর্মী, এমনকি স্থানীয় রাজনৈতিক কর্মীরাও এই মিনার ঘিরে সাংস্কৃতিক জাগরণ গড়ে তুলেছিলেন। নাটক, সংগীত, কবিতা পাঠ, একুশের মেলা—সব আয়োজনের প্রাণকেন্দ্র ছিল এই শহিদ মিনার।সাবেক ছাত্রনেতা ও মুক্তিযোদ্ধা নাসির উদ্দিন চৌধুরী আবেগভরে বলেন, “আমরা এই মিনার গড়ে তুলেছিলাম স্বাধীনতার পর, তখন কলেজ ছিল ধ্বংসস্তূপে। আজ যারা এই মিনার ভেঙেছে, তারা আমাদের আত্মার ওপর আঘাত করেছে।”
নির্মম বাস্তবতা: ঐতিহ্য হারানোর বেদনা বাংলাদেশের বিভিন্ন স্থানে ভাষা আন্দোলন ও মুক্তিযুদ্ধের স্মারক সংরক্ষণে সরকার নানা উদ্যোগ নিয়েছে। অথচ সুনামগঞ্জের মতো ইতিহাসসমৃদ্ধ স্থানে সেই প্রয়াস উল্টো ধ্বংসে পরিণত হলো। এ যেন এক নির্মম পরিহাস—যেখানে শহিদদের রক্তে সিক্ত মাটিতেই আজ ইতিহাসের অবমাননা ঘটে গেল।একজন প্রবীণ শিক্ষক বলেন, “এই মিনারটি আমাদের আত্মপরিচয়ের প্রতীক। এটি গুঁড়িয়ে ফেলা মানে আমাদের সন্তানদের ইতিহাসচেতনা মুছে দেওয়া।”
জনমতের দাবি: জবাবদিহি ও পুনর্নির্মাণ এখন সুনামগঞ্জবাসীর একটাই দাবি—দায়ীদের বিরুদ্ধে কঠোর ব্যবস্থা ও অবিলম্বে শহিদ মিনারের আগের কাঠামোতে পুনর্নির্মাণ। তারা বলছেন,“যারা ইতিহাসের সঙ্গে এমন নির্মম আচরণ করেছে, তাদের বিচার চাই। আর মিনারটি ফিরিয়ে দিতে হবে তার আসল রূপে—যেমনটি ছিল ষাটের দশকে।” সামাজিক সংগঠনগুলো ইতিমধ্যে গণস্বাক্ষর কর্মসূচি ও মানববন্ধনের ঘোষণা দিয়েছে। শিক্ষার্থী ও সাবেক ছাত্ররা বলছেন, এই আন্দোলন এখন আর কোনো দলের নয়—এটি ইতিহাস রক্ষার আন্দোলন।
ইতিহাসের প্রতি দায়বোধ ফেরাতে হবে সুনামগঞ্জ সরকারি কলেজের শহিদ মিনার ধ্বংসের ঘটনা কেবল একটি স্থাপনা ভাঙা নয়, এটি একটি সমাজের সাংস্কৃতিক চেতনাকে আঘাত করা।
যে প্রজন্মের হাতে এই দেশের ভবিষ্যৎ, তাদের চোখের সামনেই যদি শহিদদের স্মৃতি গুঁড়িয়ে দেওয়া হয়, তবে তারা কেমন ইতিহাস নিয়ে বড় হবে? বাংলাদেশের শিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলো শুধু জ্ঞানের কেন্দ্র নয়—এগুলোই হওয়া উচিত ইতিহাস ও চেতনার ধারক। এই মিনারের ধ্বংস তাই একটি জাতীয় আত্মবিস্মৃতির প্রতীক। এখন সময় এসেছে, দায়ীদের জবাবদিহিতার আওতায় এনে ঐতিহ্যকে ফিরিয়ে আনার। কারণ—শহিদ মিনার শুধু ইট-পাথরের নির্মাণ নয়, এটি একটি জাতির আত্মপরিচয়ের প্রতীক। সেই প্রতীক গুঁড়িয়ে দিলে, আমরা নিজেরাই গুঁড়িয়ে যাই ইতিহাস থেকে।
Leave a Reply