বিদ্যাসাগরের চোখ
বিদ্যাসাগরের চটিজুতা নিয়ে গল্প আছে। গল্প আছে আছে গান্ধীজীর কৌপিন নিয়েও। এ নিয়ে তাঁরা নিজেরা বহুবার প্রত্যাখাত, বিদ্রুপ কিংবা নানান প্রশ্নের সম্মুখিনও হয়েছেন। তাদের কাছ থেকে এর উত্তর ও ব্যাখাও আমাদের অজানা নেই। এবং তাতে দু’জনেরই স্বাজাত্য চেতনা, স্বজাতির অবস্থান, আবহাওয়া এবং ব্যক্তি হিসেবে তাঁদের নিজস্ব উপলব্ধিই কারণ হিসেবে উঠে এসেছে। লক্ষ্য করুন এ দু’টোই হল তাঁদের বহিরঙ্গের -পোশাকের অংশ বা অনুষঙ্গ। কিন্তু কথা সেটা না। কথা হল, আমি বিদ্যাসাগরের ব্যাপারে তাঁর তালতলার চটিজোড়াকে চোখের পর্যায়ে নিয়ে আসতে চাই। কিভাবে? তা’হলে আরেকটু বিস্তৃত পরিসরে যেতে হবে। আর সেখানে গেলেই দেখতে পাবো নারীর স্বত্ত্বার চিহ্নায়ণে বিদ্যাসাগরের দৃষ্টি।
এখন বলছি পাদুকা বা জুতা নিয়ে। এ এমনই অনুষঙ্গ যে সামান্য অস্বস্তিও অগ্রাহ্য করা যায় না। গায়ের জামা, কোট, মোজা, মাফলার একটু উনিশ কুড়ি হলেও চালিয়ে দেয়া যায়। কিনতু জুতো? কষ্মিন কালেও নয়। তাই অন্যের জুতো পরে হাঁটলেই যা লাগে পায়ে যে না খুলে ফেলা পর্যন্ত নিস্তার হয় না। অন্যভাবে বলা যায় অন্যের জুতো পায়ে পরলে তবেই তাকে বোঝা যায়। এ থেকেই হয়তো ইংরাজীতে একটা প্রবাদ তোরি হয়েছে। তা হল ‘পুট ইয়োরসেলফ ইন সামবডি এলসেস স্যু’জ অর প্লেস’ তবেই বুঝবে আসল কথা। কারণ এতে পুরো প্রেক্ষিতটাই বদলে যায়। সত্যি শোষনকারী যদি একবার শোষিতের স্থানে গিয়ে দাঁড়াতো তাহলেই সে পালটা পৃথিবীর দঃখ বা সুখ বুঝতে পারতো। আমি বলতে চাই বিদ্যাসাগরের বাহ্যিক জুতোজোড়া তাল তলারচটি হলেও তাঁর আসল চটিজোড়া ছিল নারীর। তিনি নারীর জুতোয় হেঁটেছিলেন বলেই দেখতে পেয়েছিলেন নারীর স্বত্ত্বা- পুরুষের অগোচরে থেকে যাওয়া বাকি অর্ধেক পৃথিবী।
বিদ্যাসাগর সম্পর্কে মাইকেল মধুসুদন লিখেছিলেন, ‘তাঁর মধ্যে রয়েছে প্রাচীন ঋষির প্রতিভা ও প্রজ্ঞা, ইংরাজের সতেজ কর্মশক্তি এবং বাঙালি মায়ের হৃদয়।’ লক্ষ্য ক্রুন বাঙলি মায়ের হৃদয় শব্দটি। এর উপলব্ধি কি সুন্দর ইতিবাচক ভাবে উঠে এসেছে বাংলা সাহিত্যে নব জাগরনের কবির ভাষ্যে। আমরা জানি একজন নারী জীবন ও জগতে কেবল নিজস্বার্থ চিন্তা করে না। সংসারের সবার কথা ভেবেই এমনকি কখনো বৃহত্তর সংকট এড়াবার নিজে অতি অল্প খেয়ে, অতি অল্প দেখে, অতি অল্প সময় ঘুমিয়ে- অনেক বেশি দিয়ে পরিয়ে ও মুড়িয়ে যায় বাকিদের। তাদের নিজেদের বৃদ্ধি, আরাম, সুশ্রুষা, বিশ্রাম, সাধ সবই আড়ালে থেকে যায়। কী যে আড়ালে থেকে যায় বা কোথায় কোথায় তাহাদের ব্যথা তাহা জানার একমাত্র উপায় হল তাদের স্থানে দাঁড়িয়ে জীবন দেখা। আমি বলতে চাই বিদ্যাসাগর নারীর জুতোতে নিজেকে গলিয়ে তাই পর্যবেক্ষ্ন করেছেন বলেই নারীর স্বত্তা চিহ্নায়নে সমর্থ হয়েছিলেন।
কি সেই স্বত্ত্বা? নারীর কোমলতা, মাতৃত্ব, পারঙমতা? না। নারী হিসেবে পুরুষের মত যে তার রয়েছে সমান এক মানব স্বত্ত্বা। যেখানে নায্যতার কথা বলতে হয়। আমি তথাকথিত নারীবাদীদের মত সমতার কথা বলি না। বলি নায্যতার কথা। বলি নারী ও পুরুষের ভিন্নতাই সুন্দর। সেটা স্বীকার করে তাদের ভিন্ন ভিন্ন শক্তির শুভপরিনয়েই জগতের কাজগুলোর সহজ সুরাহা সম্ভব। ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগর সেই মর্মে কাজ করেছেন। সেই মর্মে পুরুষ হয়েও নারীসুলভ মন নিয়ে, মাতৃহৃদয় নিয়ে তিনি ‘জনহিতকর’, ‘জনকল্যানের’ জন্য কাজ করেছেন।
তিনি তখনকার সমাজ থেকে এত নিন্দা কাঁটায় বিদ্ধ হয়েছেন যে বিশ্বকবি যথার্থই বলেছিলেন যে, যাঁরা মহাপুরুষ ‘বাহিরের অগৌরব তাঁদের অন্তরের সেই সম্মানের টীকাকেই উজ্জ্বল করে তোলে– অসম্মানই তাঁদের পুরস্কার।’ বিধবাবিবাহ আইন প্রণয়ন, বহুবিবাহ রোধ ও বাল্য বিবাহ বন্ধ করতে গিয়ে তিনি বহু মানুষের ব্যঙ্গ, বিদ্রুপ, প্রতিরোধের সম্মুখীন হয়েছেন। তাঁকে বিদ্রুপ করে কবিতা লেখা হয়েছে। বঙ্কিমচন্দ্রের মতো সাহিত্যিকও বিভিন্ন লেখালেখির মাধ্যমে বিদ্যাসাগরের বিধবাবিবাহ আন্দোলনের বিরোধিতা করছেন। বিষবৃক্ষ উপন্যাসের সূর্যমুখী চরিত্রের মাধ্যমে বিধবাবিবাহ আন্দোলনকে কটাক্ষ করছেন তীব্র ভাষায়। শরৎচন্দ্র তাঁর গল্পে উপন্যাসে কিছু কিছু আচার ও বিধবার সৌন্দর্য্য এমন ভাবে তুলে ধরেছেন যে তাতে আকর্ষিত না হবার উপায় থাকে না। শুনেছি স্বামী বিবেকানন্দও নাকি বিধবাদের ব্যাপারে ইতিবাচক কথাই বলে গেছেন। ব্রিটিশ সিভিল সার্ভিস মানে ‘সুশীল সেবাদানকারী সংস্থার’ বিচারক ছিলেন বঙ্কিমচন্দ্র। এমনকি তিনি ছিলেন বাংলা সাহিত্যে প্রকরণগত দিক থেকে আধুনিক উপন্যাসের জনক সেই তিনি কি করে লিখেন,’যে বিধবার বিবাহের ব্যবস্থা দেয়, সে যদি পণ্ডিত তবে মূর্খ কে?’
তাঁর নানান জন হিতকর কাজের মধ্যে নারীর হিত তথা সমাজের হিতই প্রধান ছিল। তিনি ‘জন’ শব্দের মধ্যে নারী ও পুরুষ উভয়ের হিত বুঝতেন। নারীর হিত হলেই তবে জনহিত হবে একথা মনে করতেন। পরবর্তী সময়ে মুসলমান মেয়েদের অন্তঃপুর থেকে সে কারনেই বাইরে আনার চেষ্টা করেন রোকেয়া সাখাওয়াৎ হোসেন। বেগম রোকেয়া বলতেন, এক পায়ে মানুষ বেশিদূর এগিয়ে যেতে পারবে না, পারে না। মানুষের এগিয়ে যাবার জন্য দু’টো পা’ই সমান গুরুত্বপূর্ণ। কারণ নারী ও পুরুষ সমাজ দেহের দুই পা।
নারীও মানুষ এবং সেদিক থেকে দেখে তিনি তাদের মানবাধিকার, বোধ ও মনের স্বরূপ সমাজের কালো মুখ গহব্বর থেকে টেনে বাইরে নিয়ে আসেন। কি সেই স্বত্ত্বা? নারীর কোমলতা, মাতৃত্ব, পারঙমতা? না। নারী হিসেবে পুরুষের মত তার মানব স্বত্ত্বা। যেখানে নায্যতার কথা বলতে হয়। আমি তথাকথিত নারীবাদীদের মত সমতার কথা বলি না। বলি নায্যতার কথা। বলি নারী ও পুরুষের ভিন্নতাই সুন্দর। সেটা স্বীকার করে তাদের ভিন্ন ভিন্ন শক্তির শুভপরিনয়েই জগতের কাজগুলোর সহজ সুরাহা সম্ভব। ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগর সেই মর্মে কাজ করেছেন। সেই মর্মে পুরুষ হয়েও নারীসুলভ মন নিয়ে, মাতৃহৃদয় নিয়ে তিনি ‘জনহিতকর’, ‘জনকল্যানের’ জন্য কাজ করেছেন। সমাজের চোখের গেরোগুলো খুলে দিতে সচেষ্ট হয়েছেন। নারীর প্রতি কোন পক্ষপাত তার ছিলনা। তাঁর চোখে ছিল সমাজ স্বচ্ছ চশমা। সে ও আজ থেকে দুইশত বছর আগে ভাবা যায়! যায় না।
নারীর কোন নিজস্ব স্বত্ত্বা আছে তা উনবিংশ সময়ের সমাজের মানুষের বোধের মধ্যেই ছিলনা।মানুষ যা দেখে বেড়ে ওঠে তাতে অসংগতি সাধারণত দেখতে পায় না। আরও পায় না যদি না তার নিজের জীবন যাপনে কোন বিঘ্ন না ঘটায়। উপরোন্তু এই বিধবাদের বিয়ে না হওয়া, পুরুষের বহু বিবাহ করা, বাল্য বিবাহ সবই সমাজের পুরুষের যৌন সুবিধা, সেবা প্রাপ্তি, সম্পত্তি লাভ প্রুষের বাড়তি লাভ ও সুবিধা করে দিচ্ছিল।
তাতে নারীর মনে ও মানসিকতায়, তার দেহে, তার অর্থনৈতিক সংস্থানে, স্বাস্থ্যে, মানুষ হিসাবে তার অধিকারে কি প্রভাব, প্রতিফল, অন্যায় হচ্ছে তা বিদ্যাসাগরই উঠিয়ে আনেন। প্রশ্ন বিদ্ধ করেন।
পুরুষের দ্বারা পরিচালিত সমাজে পুরুষ স্বত্তা ও তার চাহিদা স্বীকৃত। তা থেকেই বর্বর সহমরণ প্রথা ছিল যা বন্ধ করার জন্য মূল কাজ ও আন্দোলন করেন রাম মোহন রায়। একটি বিদেশী শাসকের জন্য যা অগ্রহনীয় ছিল নিজ সমাজের সুবিধাভোগী পুরুষ নেতাদের কাছে তা ছিলনা।
স্বামীই পরমার্থ প্রথা- মানে তুমি যদি সতী হও স্বামী ছাড়া তোমার কোন জীবন নেই। এযে স্বামী নয় আরেকজন মানুষ যিনি একজন নারীর মতই দেহ ও মনে সুখ সুবিধা লাভের সমান অধিকারী- তা তিনি বোঝেন কিন্তু নারীকে বুঝতে দেননি। ছেলে-শিশুদের সে অর্থেই বড় করে তোলা হয়েছে। অধিকাংশ নারী এতে সে কি থেকে বঞ্চিত হল তাহাও উপলব্ধির সুযোগ দেয়া হয়নি। এর সবই তিনি আঁচ ও আন্দাজ করতে পেরেছিলেন।
কথা হল এসব কথা কি বিদ্যাসাগরের কালে যারা তার বিরোধিতা করেছেন তারা তা বূঝেন নি বা উপলব্ধি করতেন না? খুব করতেন। কতৃত্বটা চলে যাবার আশংকায় তা চাইতেন না। এরকম সময় সমাজের অনেক নামকরা মানুষ প্রতিক্রিয়াশীলদের পক্ষে না গেলেও বিপক্ষে যান নি। বিদ্যাসাগরের এই নারীকল্যান বিষয়ে কাজ করার জন্য গেল গেল সমাজ রসাতলে গেল বলে তাঁর প্রাণনাশেরও হুমকি দেওয়া হয়েছে। বছরের পর বছর মা’কে দেখতে যেতে না পেরে কেঁদেছেন। এমন কি মানুষের সামনেও। এতে তার পৌরুষত্ব খর্ব হচ্ছে ভাবেন নি। যে সমাজে স্বাভাবিক ব্যর্থতা, কানা, অপারগতা লুকিয়ে পুরুষকে শক্তিশালি ও মহত দেখানোর জন্য বাল্যকাল থেকে শিক্ষা দেয়া হয় – তিনি তার বিপরীতে দাঁড়িয়েছেন। তিনি বলেন,’এদেশের উদ্ধার হতে বহু বিলম্ব আছে। পুরনো স্বভাব ও প্রবৃত্তির মানুষের চাষ উঠিয়ে দিয়ে, সাত পুরু মাটি তুলে ফেলে, নতুন মানুষের চাষ করতে পারলে, তবে যদি এদেশের ভালো হয়।’
বাংলাদেশে হিজাব নেকাব ও নানান অনুশাসনে ও ধর্ষনে ধর্ষনে নারীকে যেভাবে আবার বাক্সবন্দী করে পেছনে নিয়ে যাওয়া হচ্ছে তা দেখে আমার আশ্চর্য লাগে। ভাবতে বাধ্য হই যে দু’শো বছর পরেও আমাদের দেশ ও সমাজের প্রকৃতি বদলে নি। তিনি তাই এখনো প্রাসঙ্গিক। তিনি ঈশ্বরবাদী, বস্তুবাদী, বেদান্তবাদী, অজ্ঞেয়বাদী এমনকি নারীবাদীও নন। তিনি মানবতাবাদী। তিনি বক্তৃতা ও গালভরা তত্ত্ব বলেন নি। তিনি সামগ্রিকভাবে মানবকল্যানের নিমিত্তে উদয়াস্ত কাজ করতে গিয়ে যেখানে যেখানে অপূর্ণতা দেখেছেন সেখানেই কাজ করেগেছেন। বিদ্যাসাগর সমাজের চোখের গেরোগুলো খুলে দিতে সচেষ্ট হয়েছেন। নারীর প্রতি কোন পক্ষপাত তার ছিলনা। তাঁর চোখে ছিল সমাজ স্বচ্ছ চশমা। সে ও আজ থেকে দুইশত বছর আগে ভাবা যায়! যায় না।
Leave a Reply