নগর কৃষি মেলায় কাব্যপ্রবাহ :
সবুজ আন্দোলনের নতুন রূপকথা
আনোয়ার হোসেন রনি
ইট-কাঠ-পাথরের ব্যস্ত রাজধানী। ক্লান্ত নগরবাসীকে প্রতিদিনই লড়তে হয় যানজট, ধুলোদূষণ, অনিশ্চয়তা আর অস্থিরতার সঙ্গে। ঠিক সেই শহরের বুকেই গড়ে উঠেছে এক টুকরো সবুজ স্বর্গ—চতুর্থ নগর কৃষি মেলা ২০২৫। ছয় দিনব্যাপী আয়োজিত এই মেলার চতুর্থ বছরেও দেখা মিলছে নগরবাসীর প্রাণের স্পন্দন, পরিবেশ সচেতনতার নতুন দিগন্ত এবং শহুরে কৃষির বিকল্প সম্ভাবনার। মেলার পঞ্চম দিনের পরিবেশ ছিল একদম আলাদা—প্রকৃতি, কৃষি ও সাহিত্য যেন একই মঞ্চে পরস্পরকে আলোকিত করেছে।
যেখানে কৃষিপণ্য, বীজ, চারা, জৈব সার ও মাটির পসরা সাজানো থাকে, সেখানে এবার যুক্ত হয়েছে আরও একটি মাত্রা—শব্দের কৃষিকর্ম। কবিতা, গান, গল্প আর আবৃত্তিতে প্রকৃতি যেন পেয়েছে মানবিক ভাষা। অস্থির নগরে স্থিরতার আরেক নাম—নগর কৃষি মেলা গত কয়েক বছর ধরে ঢাকার নাগরিক জীবনে ক্রমেই জনপ্রিয় হচ্ছে ছাদবাগান, ব্যালকনি বাগান বা ক্ষুদ্র পরিসরে সবজি চাষ। নগর কৃষি ফাউন্ডেশন শুরু থেকেই এই প্রবণতাকে কর্মযজ্ঞে রূপ দিতে কাজ করছে। কৃষি–বিজ্ঞানীদের পরামর্শ, প্রশিক্ষণ, চারা বিতরণ, জৈব সার তৈরি—সবই এর অংশ। নগরবাসীর দোরগোড়ায় কৃষি পৌঁছে দেওয়ার সেই প্রচেষ্টারই ধারাবাহিক বিস্তার হলো এই মেলা।
নগর কৃষি ফাউন্ডেশনের কর্মকর্তারা জানালেন“শহুরে জীবনের চাপের ভেতর মানুষ একটু স্বস্তি খোঁজে। আর একটি গাছ, একটি পাতা, একটি ফল—মানুষের সেই যন্ত্রণার প্রতিষেধক। আমরা চাই শহরের প্রতিটি ছাদ সবুজ হোক।”প্রকৃতি যেন আজ তাদের এই আহ্বানে সাড়া দিয়েছে। হিমেল বাতাস ও শীতের চাঁদরেও দর্শনার্থীদের ভিড় একটুও কমেনি। সারাদিনের যানজট ও ব্যস্ততা ভুলে ছুটে এসেছে মানুষ—কেউ নতুন বীজ কিনতে, কেউ ছাদবাগানের পরামর্শ নিতে, কেউ আবার শুধু এই সবুজ পরিবেশে একটু স্বস্তি খুঁজতে।
সাহিত্য যুক্ত হলো কৃষি আন্দোলনের সঙ্গে গত বছর প্রথমবারের মতো নগর কৃষি মেলায় যুক্ত করা হয় লেখক–কবি–সাহিত্যিকদের মিলনমেলা। এর উদ্দেশ্য ছিল প্রকৃতি ও কৃষি বিষয়ে সচেতনতা তৈরি করা, মানুষকে নতুন দৃষ্টিভঙ্গিতে ভাবতে উদ্বুদ্ধ করা। সেই উদ্যোগ এবার আরও বিস্তৃত হয়েছে। মেলার পঞ্চম দিনের বিশেষ আয়োজনে তাই ছিল—
কথা, কবিতা, গান ও আবৃত্তির সমন্বয়ে এক অনন্য সবুজ সাহিত্য আসর। অংশগ্রহণ করেছেন দেশের বিভিন্ন প্রান্তের কবি ও কথাসাহিত্যিকেরা। মঞ্চে উপস্থিত ছিলেন—
কবি মানিক মোহাম্মদ রাজ্জাক,কবি আব্দুর রাজ্জাক,
কবি তাহমিনা কোরাইশী,কবি আনারকলি,কবি নিগার সুলতানা,কবি শাহান আরা জাকির,কবি মাহবুবা ফারুক,
কবি সেশী সেলিনা,কবি নীল হাসান,কবি আহাদুল্লাহ,
কথাসাহিত্যিক নূর কামরুন নাহার,কবি হেনা সুলতানা,কবি মুক্তি পিয়াসী,এ ছাড়া আরও বেশ কয়েকজন কবি–সাহিত্যিক অংশ নিলেও সবার নাম তাৎক্ষণিকভাবে মনে রাখা সম্ভব হয়নি।একই মঞ্চে এত জন কবির উপস্থিতি মেলাটিকে পরিণত করেছে নতুন ধাঁচের সংস্কৃতি–কৃষি উৎসবে। প্রকৃতির প্রতি ভালোবাসা—শব্দে, সুরে, অনুভবে মেলার মঞ্চে যে আবহ তৈরি হয়, তা শুধু সাহিত্য আসর নয়—এ যেন প্রকৃতির প্রতি শ্রদ্ধা জানানোর একটি সম্মিলিত উৎসব।
কবি তাহমিনা কোরাইশী উচ্চারণ করেন—গাছের ছায়ায় যতবার দাঁড়িয়েছি, ততবারই নিজেকে নতুন করে চিনেছি। প্রকৃতি শেখায় মানুষ হওয়া।”কবি নীল হাসান ছন্দে ছন্দে তুলে ধরেন নগরের যন্ত্রণা—
“ইটের নগর ক্লান্ত রাত,
শ্বাস নেবারও নেই তো ফাঁট—
তবু একটি ফুলের গন্ধে
জীবন পায় নতুন প্রভাত।”
দর্শক সারিতে তখন নস্টালজিয়া, বিস্ময় আর প্রশান্তির মিশ্র প্রতিক্রিয়া। শুধু প্রাপ্তবয়স্করাই নন, মঞ্চের দিকে দৌঁড়ে আসে দুই ক্ষুদে আবৃত্তিকার। তাদের আবৃত্তি শুনে উপস্থিত সবার মুখে প্রশংসার ঝিলিক। শহরের একঘেয়েমিতে জন্ম নেওয়া শিশুমনেও আজ প্রকৃতি আর কবিতার প্রতি ভালোবাসার বীজ বুনে দেয় এই অনুষ্ঠান। সভ্যতা এগোয়, সবুজ কমে—তাই সচেতনতার নতুন ডাক বিশেষজ্ঞরা মনে করেন, কৃষির সাথে সাহিত্য, সঙ্গীত ও সংস্কৃতির মিলন সমাজে গভীর প্রভাব ফেলে। নগর কৃষি ফাউন্ডেশনের এক কর্মকর্তা বলেন—
“মানুষকে শুধু গাছ লাগানোর কথা বললেই হয় না। তাদের মনেও একটি গাছ লাগাতে হয়। শিল্প-সাহিত্য সেই কাজটাই করে। এ কারণেই আমরা এই আয়োজন করেছি।”এই দৃষ্টিভঙ্গি নতুন। কৃষিকে আর কেবল উৎপাদনমুখী খাত হিসেবে দেখা হচ্ছে না; বরং মানুষের মানসিক স্বাস্থ্য, পরিবেশ সচেতনতা ও সামাজিক সম্প্রীতির অংশ হিসেবে গণ্য করা হচ্ছে। নগর কৃষি মেলার কবিতা-গান তাই শুধু বিনোদন নয়, বরং এক ধরনের পরিবেশ আন্দোলনেরই সূক্ষ্ম ভাষ্য।
ভালোবাসা ও আপ্যায়ন—আয়োজকদের মানবিক স্পর্শ
মঞ্চে শুধু শব্দের উৎসব হয়নি। দর্শক-অতিথিদের আপ্যায়নেও ছিল মানবিক উষ্ণতা। গরম চা, স্যান্ডউইচ, মাশরুমের গরম পাকোড়া—সব মিলিয়ে এক পরিপূর্ণ আয়োজন। ব্যস্ত শহরে মানুষের হৃদয়ে যে নির্লিপ্ততা জমে, তা যেন এক কাপ চায়ের উষ্ণতায় গলে গেল।
অনুষ্ঠানে আগত দর্শনার্থীরা একমত—এমন আয়োজন শহরের মানুষকে শুধু আনন্দ দেয় না, সম্পর্ক তৈরি করে, নতুন সামাজিক বন্ধন গড়ে।নগর কৃষি—শুধু শখ নয়, আগামী দিনের প্রয়োজন বিশ্বব্যাপী নগর কৃষি এখন টেকসই নগর উন্নয়নের অপরিহার্য অংশ। জলবায়ু পরিবর্তন, খাদ্য নিরাপত্তা ও সবুজের সংকটে বাংলাদেশও এখন নগর কৃষিকে নতুনভাবে ভাবতে বাধ্য। ছাদচাষ, টবচাষ, হাইড্রোপনিক্স কিংবা উল্লম্ব কৃষি—সবই ধীরে ধীরে জনপ্রিয়তা পাচ্ছে।
মেলায় বিজ্ঞানীরা জানালেন,শহুরে বাগান বায়ুদূষণ কমায়
পরিবেশের তাপমাত্রা ২–৩ ডিগ্রি পর্যন্ত কমানোর ক্ষমতা রাখে
মানসিক চাপ কমায় পরিবারের পুষ্টি চাহিদা পূরণ করে
নারী উদ্যোক্তা তৈরি করে জৈব কৃষির মাধ্যমে সুরক্ষিত খাদ্য নিশ্চিত করে তাই এই মেলা শুধু কেনাবেচার নয়—একটি সবুজ বিপ্লবের অংশ। অনুসন্ধানী দৃষ্টিতে মেলার সামাজিক তাৎপর্য এই প্রতিবেদনের গবেষণার অংশ হিসেবে দর্শক, বিক্রেতা, কবি ও আয়োজকদের সঙ্গে কথা বলে যে তথ্য জানা গেছে—১. শিশুদের উপস্থিতি ও অংশগ্রহণ বাড়ছে। ছাদবাগান এখন অনেক স্কুলের সহ-পাঠ্যক্রম কার্যক্রমে যুক্ত হয়েছে।২. নারী উদ্যোক্তা ও হোম গার্ডেনাররাই মেলার মূল ক্রেতা ও সক্রিয় অংশগ্রহণকারী। ৩. সাহিত্যিকদের যুক্ত হওয়ায় তরুণদের মধ্যে পরিবেশ সচেতনতায় নতুন আগ্রহ তৈরি হচ্ছে।৪. কৃষি মেলার সাংস্কৃতিক উপাদান মানুষকে দীর্ঘসময় মেলায় ধরে রাখে—যা সচেতনতা বৃদ্ধিতে বড় ভূমিকা রাখছে।৫. নগরের বাণিজ্যিক কৃষি—যেমন ছাদে বাণিজ্যিক সবজি উৎপাদন, মাশরুম চাষ, অর্গানিক পণ্য বিক্রি—একটি নতুন বাজার তৈরি করছে। এগুলো প্রমাণ করে—মেলাটি এখন শুধু উৎসব নয়, গবেষণাযোগ্য সামাজিক ঘটনা।
ফুলের নান্দনিক পরিবেশে কবিতার বাগান মেলার সবুজ আঙিনা যেন ছবির মতো সুন্দর। রঙ-বেরঙের চন্দ্রমল্লিকা, গাঁদা, অর্কিড, এন্টুরিয়াম, গোলাপ, ডালিয়া—সব মিলিয়ে চোখজুড়ানো পরিবেশ। ফুলের সৌন্দর্যের ভেতর দাঁড়িয়ে কবিতার উচ্চারণ যেন নতুন মাত্রা পায়।
এক কথায়—প্রকৃতি, কৃষি, সাহিত্য, সংস্কৃতি—সব মিলে একটি পূর্ণাঙ্গ নাগরিক উৎসব। সবুজে ফেরার ডাক চতুর্থ নগর কৃষি মেলা শুধু কৃষিকে জনপ্রিয় করা নয়, বরং শহরের মানুষের মনে সবুজের প্রতি আকাঙ্ক্ষা আরও জোরালো করেছে। অস্থির সময়ের ভিড়ে, যানজটের ক্লান্তি ও ধুলো মেখে থাকা নগরে এমন একটি স্নিগ্ধ আয়োজন মানুষকে নতুন করে বাঁচার শক্তি দেয়। এই মেলায় কবিদের উপস্থিতি, শিশুদের আবৃত্তি, দর্শকদের স্বতঃস্ফূর্ত কবিতা পাঠ—সবই প্রমাণ করে,
মানুষ প্রকৃতিকে ভালোবাসে, শব্দকে ভালোবাসে, জীবনকে ভালোবাসে। সবুজ আঙিনায় এমন কাব্য প্রবাহ অব্যাহত থাকুক। শহরের প্রতিটি ছাদ, প্রতিটি হৃদয়ে ফুটুক এক টুকরো সবুজ কবিতা।
Leave a Reply