জেনারেল এম এ জি ওসমানী: অবিস্মরণীয় মহীরুহ,
জাতির মুক্তির মহান সেনানায়ক
আনোয়ার হোসেন রনি
বাংলাদেশের স্বাধীনতার ইতিহাসে যে কয়েকজন মানুষ কিংবদন্তি হয়ে আছেন— জেনারেল এম এ জি ওসমানী তাদের মধ্যে অন্যতম। তিনি শুধু একজন সেনানায়ক নন, ছিলেন একটি জাতির প্রতিরোধ, সম্মান ও আত্মমর্যাদার প্রতীক। পাকিস্তানি সেনারা তাকে ডাকতো “পাপা টাইগার”— তার নাম শুনলেই কেঁপে উঠতো শত্রু শিবির। স্বাধীনতার যুদ্ধের সময় তিনি ছিলেন সেই বীর যোদ্ধা, যার নেতৃত্বে জন্ম নেয় মুক্তিকামী বাঙালির সশস্ত্র বাহিনী— বাংলাদেশ সেনাবাহিনী।
শৈশব ও শিক্ষাজীবনের বিস্ময় ১৯১৮ সালের ১ সেপ্টেম্বর সুনামগঞ্জে জন্ম নেন মোহাম্মদ আতাউল গণি ওসমানী।
তার পৈতৃক বাড়ি ছিল সিলেটের বালাগঞ্জ থানার দয়ামীর গ্রামে, যা বর্তমানে ওসমানীনগরউপজেলা হিসেবে পরিচিত। পিতা খান বাহাদুর মফিজুর রহমান ছিলেন সুনামগঞ্জের এসডিও, আর মাতা ফাতেমা খাতুন ছিলেন সিলেটের ঐতিহ্যবাহী পরিবারের সন্তান। বাবার চাকরির সুবাদে ছোটবেলা থেকেই ওসমানীর জীবনে আসে ভ্রমণ, শিক্ষা আর শৃঙ্খলার মিশেল। গোহাটিতে তাঁর প্রাথমিক শিক্ষা শুরু। ১৯৩৪ সালে সিলেট সরকারি উচ্চ বিদ্যালয় থেকে ম্যাট্রিকুলেশন পরীক্ষায় তিনি পুরো ভারতবর্ষে প্রথম স্থান অর্জন করেন— যা ছিল তৎকালীন ব্রিটিশ ভারতের জন্য এক বিস্ময়কর ঘটনা। এই কৃতিত্বের জন্য তিনি ব্রিটিশ সরকারের ‘প্রাইওটোরিয়া পুরস্কার’ পান।
পরবর্তীতে আলীগড় মুসলিম বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ১৯৩৮ সালে স্নাতক ডিগ্রি অর্জন করেন। এরপরই তাঁর জীবনে শুরু হয় নতুন অধ্যায়— সামরিক জীবনের।
ব্রিটিশ সেনাবাহিনীতে তরুণ অফিসার
১৯৩৯ সালে তিনি রয়্যাল আর্মড ফোর্সে ক্যাডেট হিসেবে যোগ দেন। ভারতের দেরাদুনের বিখ্যাত ব্রিটিশ-ইন্ডিয়ান মিলিটারি একাডেমি থেকে প্রশিক্ষণ শেষে ১৯৪০ সালে কমিশনড অফিসার হিসেবে ব্রিটিশ সেনাবাহিনীতে যোগ দেন। মাত্র ২৩ বছর বয়সে তিনি মেজর পদে পদোন্নতি পান— ব্রিটিশ সাম্রাজ্যের ইতিহাসে সর্বকনিষ্ঠ মেজর হিসেবে। তখন থেকেই তাঁর তীক্ষ্ণ বুদ্ধি, অসাধারণ নেতৃত্বগুণ ও কৌশলগত দক্ষতা তাঁকে করে তোলে বিশেষ। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময় বার্মা ও উত্তর আফ্রিকার যুদ্ধক্ষেত্রে তাঁর নেতৃত্ব ওসমানীকে এনে দেয় ‘অভিজ্ঞ যোদ্ধা’র মর্যাদা।
পাকিস্তান সেনাবাহিনীতে অধ্যায় ১৯৪৭ সালে ভারত বিভাগের পর ওসমানী যোগ দেন নবগঠিত পাকিস্তান সেনাবাহিনীতে। তাঁর পদমর্যাদা ছিল লেফটেন্যান্ট কর্নেল। পরে তিনি ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্ট গঠনে মুখ্য ভূমিকা পালন করেন। ১৯৫১ সালে তিনি প্রথম ব্যাটালিয়নের অধিনায়ক হিসেবে চট্টগ্রাম সেনানিবাস প্রতিষ্ঠা করেন।
তাঁর হাতে ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্ট গড়ে ওঠে জাতিগত মর্যাদা ও শৃঙ্খলার প্রতীক হিসেবে। বাঙালি সৈন্যদের মধ্যে দেশপ্রেম, আত্মবিশ্বাস ও সামরিক দক্ষতা সঞ্চার করেছিলেন এই অসাধারণ কর্মকর্তা।
১৯৬৭ সালে মেজর জেনারেল পদে তিনি সেনাবাহিনী থেকে অবসর গ্রহণ করেন। কিন্তু তাঁর জীবনের সবচেয়ে উজ্জ্বল অধ্যায় তখনো লেখা বাকি। স্বাধীনতার যুদ্ধ ও “সেনাপতি ওসমানী”
১৯৭০ সালে আওয়ামী লীগের প্রার্থী হিসেবে সংসদ সদস্য নির্বাচিত হন এম এ জি ওসমানী। পরের বছর ঘটে ইতিহাসের সবচেয়ে ভয়াবহ ঘটনা— ২৫ মার্চের কালরাত্রি। ঢাকায় তখনই অবস্থান করছিলেন তিনি। পাকিস্তানি বাহিনীর কাছে তাঁর নাম ছিল আতঙ্কের সমান। তাই তাঁকে হত্যার পরিকল্পনাও করা হয়েছিল। কিন্তু অলৌকিকভাবে তিনি প্রাণে বেঁচে যান।
দেশব্যাপী হত্যাযজ্ঞ শুরু হলে সীমান্ত পেরিয়ে ভারতে চলে যান ওসমানী। মুজিবনগরে তখন তাজউদ্দীন আহমদ নেতৃত্বে গঠিত হয় বাংলাদেশ সরকার। ১২ এপ্রিল ১৯৭১ সালে তাঁকে বাংলাদেশ সশস্ত্র বাহিনীর প্রধান সেনাপতি হিসেবে নিয়োগ দেওয়া হয়। সেদিন থেকেই শুরু হয় ওসমানীর ইতিহাসগড়া নেতৃত্বের অধ্যায়।
যুদ্ধের কৌশল ও মুক্তিবাহিনীর গঠন ওসমানীর নির্দেশনায় পুরো দেশকে ১১টি সেক্টরে ভাগ করা হয়। প্রতিটি সেক্টরে নিযুক্ত করা হয় দক্ষ কমান্ডার— যারা তাঁর নির্দেশে পরিচালিত হতেন। গেরিলা প্রশিক্ষণ, অস্ত্র সরবরাহ, আন্তর্জাতিক সমর্থন— সব ক্ষেত্রেই ওসমানীর নেতৃত্ব ছিল সুসংগঠিত ও দূরদর্শী।
প্রথমদিকে তিনি নিয়মিত যুদ্ধ কৌশল অনুসরণ করলেও পরবর্তীতে বুঝতে পারেন— শত্রুর তুলনায় মুক্তিবাহিনীর সংখ্যা কম, তাই সরাসরি যুদ্ধের চেয়ে গেরিলা কৌশলই বেশি কার্যকর। তাঁর নির্দেশে গঠিত হয় গেরিলা বাহিনী ও নৌ-কমান্ডো দল। আগস্টের মাঝামাঝি তারা নদীপথে পাকিস্তানি চলাচল প্রায় রুদ্ধ করে দেয়। পরে ওসমানীর তত্ত্বাবধানে তৈরি হয় ক্ষুদ্রবিমানবাহিনীও— দুটি হেলিকপ্টার, একটি অটার এবং তাঁর নিজস্ব চলাচলের জন্য একটি ডাকোটা প্লেন নিয়ে। এই সীমিত শক্তিকেও তিনি দক্ষ নেতৃত্বে কাজে লাগান সাফল্যের সঙ্গে।
বিরল সাহস ও আত্মসম্মানের প্রতীক মুক্তিযুদ্ধের মাঝামাঝি সময়ে কিছু সেক্টর কমান্ডার তাঁর নেতৃত্ব নিয়ে প্রশ্ন তোলেন। ওসমানী এতে গভীরভাবে মর্মাহত হয়ে পদত্যাগের ঘোষণা দেন। পরে তাজউদ্দীন আহমদের অনুরোধে ও সবার একান্ত চেষ্টায় তিনি আবার দায়িত্ব গ্রহণ করেন। এই ঘটনাই প্রমাণ করে— তিনি ছিলেন গণতান্ত্রিক ও নীতিবান সেনানায়ক, যিনি নিজের পদ নয়, জাতির স্বার্থকেই সর্বাগ্রে রেখেছেন।
আত্মসমর্পণ ও প্রটোকলের ইতিহাস ১৯৭১ সালের ১৬ ডিসেম্বর পাকিস্তানি সেনাবাহিনী আত্মসমর্পণ করে। ইতিহাসের সবচেয়ে গৌরবময় সেই মুহূর্তে জেনারেল ওসমানী উপস্থিত ছিলেন না।
অনেকেই ভাবেন— কেন তিনি অনুপস্থিত ছিলেন? এর উত্তর খুঁজে পাওয়া যায় ইতিহাসের ভেতরে। মুক্তিযুদ্ধ ছিল ভারত-বাংলাদেশ যৌথ কমান্ডের অধীনে। আত্মসমর্পণ অনুষ্ঠানে ভারতের পক্ষে উপস্থিত ছিলেন লেফটেন্যান্ট জেনারেল জগজিৎ সিং অরোরা— যিনি পূর্ব ফ্রন্টের আঞ্চলিক প্রধান। ওসমানী ছিলেন বাংলাদেশ সেনাবাহিনীর সর্বোচ্চ প্রধান। সেনাবাহিনীর আন্তর্জাতিক প্রটোকল অনুযায়ী একজন আঞ্চলিক প্রধানের সঙ্গে সমপদস্থ সেনাপতি একই মঞ্চে থাকতে পারেন না।
ওসমানী নিজেই পরে বলেন—“এটা কোনো অহংকার নয়, এটা প্রটোকলের বিষয়। আমি স্বাধীন জাতির সেনাপতি। আমার মর্যাদা ভারতীয় সেনাপ্রধান জেনারেল মানেকশ-এর সমান, তাঁর অধীনস্থ কারও নয়। এই কথাগুলোয় ফুটে ওঠে তাঁর অদম্য আত্মমর্যাদাবোধ, জাতিসত্তার প্রতি শ্রদ্ধা এবং ব্রিটিশ-ধারার শৃঙ্খলার প্রতি অবিচল বিশ্বাস।
মানুষ ওসমানী: চরিত্রের দীপ্তি জেনারেল ওসমানী ছিলেন ব্রিটিশ গণতন্ত্রের আদর্শে বিশ্বাসী। রাজনৈতিক শঠতা, কপটতা বা সুযোগসন্ধান— কোনো কিছুরই স্থান ছিল না তাঁর জীবনে। রাষ্ট্রের দায়িত্বে বা ব্যক্তিজীবনে তিনি ছিলেন স্বচ্ছ, সোজাসাপ্টা, ও নীতিবান। আজীবন অবিবাহিত থেকে তিনি জীবনের শেষভাগে মেঝেতে চাদর বিছিয়ে ঘুমাতেন। কোনো বিলাসিতা ছিল না তাঁর জীবনে। নিজের সম্পত্তি মৃত্যুর আগেই তিনি ট্রাস্টের মাধ্যমে বিলিয়ে দেন মানবকল্যাণে ব্যবহারের জন্য। এমন একজন সৈনিক, যিনি যুদ্ধের পরও শান্তির প্রতীক হয়ে থাকেন— তিনি এম এ জি ওসমানী।
চিরঅমর এক নাম ১৯৮৪ সালের ১৬ ফেব্রুয়ারি প্রয়াত হন এই মহান সেনানায়ক। তাঁর মৃত্যুতে পুরো জাতি হারায় একজন সত্যিকারের বীর, মুক্তিযুদ্ধের প্রাণপুরুষ। আজও তাঁর নাম শুনলে সশ্রদ্ধচিত্তে দাঁড়ায় পুরো বাংলাদেশ। সিলেটের আকাশে আজও তাঁর নামের প্রতিধ্বনি বাজে— “পাপা টাইগার”, যিনি বাঙালি জাতিকে শিখিয়েছিলেন সাহস, শৃঙ্খলা আর আত্মমর্যাদার মানে।
জেনারেল এম এ জি ওসমানী ছিলেন এক জীবন্ত ইতিহাস। তিনি তিনটি দেশের সেনাবাহিনীর অফিসার, কিন্তু তাঁর হৃদয় ছিল একটিই—বাংলাদেশ। একদিকে ছিলেন কঠোর সেনানায়ক, অন্যদিকে ছিলেন মানবিক, নীতিবান ও দেশপ্রেমিক এক মহীরুহ। তার নাম ইতিহাসের গহীনে নয়, জাতির হৃদয়ের গভীরে লেখা থাকবে—
“যিনি সেনাবাহিনীর পোশাকে ছিলেন একজন সৈনিক, আর জাতির আত্মায় ছিলেন এক মুক্তিযুদ্ধের প্রতীক।”
সূত্র:
আমি বিজয় দেখেছি – এম. আর. আক্তার মুকুল
ঢাকা-আগরতলা-মুজিবনগর – এম. এন. এ. মোহাইমেন মুক্তিযুদ্ধে সেনানায়ক জেনারেল ওসমানী ও তার অ্যালবাম – শেখ আখতারুল ইসলাম##
Leave a Reply