ছাতকে গোবিন্দগঞ্জ পয়েন্ট গোলচত্বর
ডাক্তার হারিছ আলীর নামে নামকরণ দাবি
—— আবদুল গাফফার চৌধুরী,
ঊপমহাদেশের প্রখ্যাত সাংবাদিক, সাহিত্যিক, কলামিস্ট, অমর একুশে গানের রচয়িতা।
গত ৩০ আগস্ট লন্ডনে ডা. হারিছ আলীর স্মরণে ভার্চুয়াল শোকসভা অনুষ্ঠিত হয়।সেই অনুষ্ঠানে ডা. হারিছ আলীকে নিয়ে তাঁর ঘনিষ্ঠ বন্ধু এবং ঊপমহাদেশের প্রখ্যাত সাংবাদিক, সাহিত্যিক, কিংবদন্তীর কলামিস্ট, অমর একুশে গানের রচয়িতা আবদুল গাফফার চৌধুরী দীর্ঘ আবেগঘন স্মৃতিচারণ করেন।এর এৌতিহাসিক মূল্য বিবেচনা করে আমরা দেশ-বিদেশের আগ্রহী পাঠকদের জন্যে পুরো বক্তৃতাটি হুবহু বক্তার ভাষায় সংকলন করেছি।পাঠকের সুবিধার জন্য আমরা পুরো বক্তৃতাটিকে ছোট ছোট স্বতন্ত্র প্যারায় ভাগ করে দিয়েছি।নিচে বক্তৃতাটির পূর্ণ বিবরণ দেয়া হল : ডা. হারিছ আলীর সপ্তম মৃত্যুবার্ষিকীতে আমি তাঁর স্মৃতির প্রতি শ্রদ্ধা জানাই। তাঁর পরিবার-পরিজন এবং শুভাকাঙ্ক্ষীদেরও শুভেচ্ছা জানাই। ২০ আগস্ট এ দিনটি আমাদের জন্যে অত্যন্ত বেদনাদায়ক। হারিছ আলী আকস্মিকভাবে মারা যান হৃদরোগে (২০ আগস্ট ২০১৩)। তার কিছুদিন আগে তিনি লন্ডনে এসেছিলেন।তখন সম্ভবত নুর ঊদ্দিন আহমদ, আমরা যাকে নুর ভাই বলি, তাঁকে নিয়ে আমার বাসায় এসেছিলেন। তখন দেখলাম হাসিখুশী মুখ এবং তাঁর চেহারায় কোনও পরিবর্তন হয়নি। লন্ডন থেকে চলে যাওয়ার সময় (ডিসেম্বর ১৯৮১) তাঁকে আমি যেভাবে দেখেছি, তখনও সেভাবেই দেখেছি। হাসিখুশী প্রাণবন্ত একজন মানুষ। হারিছ আলীর দেশে ফিরে যাওয়ার কিছুদিন পর তাঁর মৃত্যুসংবাদ আমরা কেঊ আশা করিনি। আমার চেয়ে বয়সে অনেক ছোট। তিনি এভাবে চলে যাবেন, এটা ধারণা করতে পারিনি। তাঁর সঙ্গে আমার পরিচয়টা খুব আকস্মিকভাবে। বঙ্গবন্ধু হত্যার এক বছর পর ১৯৭৬ সালে আমরা লন্ডনে সংগঠিত হই। এবং বঙ্গবন্ধুর হত্যাকারী ও তাদের দোসরদের ক্ষমতা থেকে ঊচ্ছেদের নামে ছোটখাটো সংগঠন গড়ে তুলি। সংগঠনের নাম ছিল ‘বাকশাল সংগ্রাম পরিষদ।’ এবং ওই সময়ে আমি একটা ‘কাগজ’ বের করি। সাপ্তাহিক ‘বাংলার ডাক’। তখন বঙ্গবন্ধুর আদর্শের অনুসারী লোক লন্ডনে খুব কম ছিল। জিয়াঊর রহমানের লোকদের প্রচারণা, ওদের লাঠিচার্জ ইত্যাদি কারণে বঙ্গবন্ধুর নামটা ঊচ্চারণেও কেঊ সাহস করত না। ওই সময়ে লন্ডনের কোথাও আমাদের আশ্রয় হয়নি। এখন বঙ্গবন্ধুর নাম সবখানে শুনি। মনে হয় ষোলো কোটি মানুষই বঙ্গবন্ধুর ভক্ত। তখন এত লোক পাওয়া যায়নি। এবং আমরা একটু আলাপ-আলোচনার জন্যে কোথায় বসব তারও কোনও স্হান ছিল না। তখন হোয়াইট চ্যাপেলে এই রয়াল লন্ডন হসপিটালের পাশে ‘সাংরিলা’ নামে একটা রেস্টুরেন্ট ছিল। এই সাংরিলা রেস্টুরেন্টে কাজ করতেন আমাদের নুর ঊদ্দিন আহমদ। তিনিই আমাদের ওখানে প্রথম বসার জায়গা করেন।ওই রেস্টুরেন্টের মালিককে আমি দেখিনি। শুনেছি তিনি বঙ্গবন্ধুর খুব ভক্ত ছিলেন। এই নুর ঊদ্দিন আহমদের কৃপায় ওইখানে আমরা এক এক করে জমায়েত হতে থাকি। আমি তখন ওখানে গিয়ে বসতাম। প্রায় রোজই যেতাম। নুর মিয়া আমাদেরকে বিনা পয়সায় রেস্টুরেন্টের খাবার খাওয়াতেন। তারপর ধীরে ধীরে এখানে সুলতান মাহমুদ শরীফ আসলেন। সৈয়দ আশরাফুল ইসলাম আসলেন, যিনি পরে মন্ত্রী হয়েছেন। আরও অনেকেই এসেছেন। আমার কাগজ ‘বাংলার ডাক’ চালানোর সাধ্য ছিল না, এরা সাহায্য না করলে। ‘বাংলার ডাক’ ব্রিকলেনে বিলি করা যেত না। বঙ্গবন্ধু হত্যাকারীদের সমর্থকরা হামলা করত। নুর ঊদ্দিন আহমদ কাগজ ব্রিকলেনে নিয়ে বিলি করতেন। এভাবেই চলছিল। তখন হঠাৎ করে লিভারপুল থেকে একটা মেয়ের চিঠি আসে। তার নামটা আমার ঠিক মনে নেই।সম্ভবত রুবি। রুবি বঙ্গবন্ধুর ঊপরে খুবই চমৎকার একটা কবিতা লিখেছেন। আমি ওইটা ছাপলাম। ওই চিঠিতে রুবির টেলিফোন নাম্বার ছিল। তাকে ফোন করলাম। তো দেখি একজন পুরুষ কথা বলছেন। ঊনি বললেন, ‘রুবি তো এখন নেই এখানে। আপনি কে?’ বললাম, ‘আমি আবদুল গাফফার চৌধুরী। বাংলার ডাকের সম্পাদক।’ তারপর তিনি জিজ্ঞেস করলেন, ‘আপনি কী রুবির কবিতা পেয়েছিলেন?’ বললাম, ‘জি, পেয়েছি। ভাল হয়েছে। ছেপেছি। তাকে বলেন আরও কবিতা পাঠানোর জন্যে।’ তারপর তো ওই মহিলা রুবি একটার পর একটা লেখা পাঠাতে লাগলেন।কবিতা, ছড়া, প্রবন্ধ ইত্যাদি। একটা প্রবন্ধে তিনি জেনারেল ওসমানীরও সমালোচনা করেছিলেন। আমি সেটাও ছেপেছিলাম। অনেকদিন পরে একদিন নূর ভাইয়ের রেস্টুরেন্ট ‘সাংরিলায়’ বসে আছি। দেখি হারিছ আলী এসে ঊপস্হিত। একজন তরুণ লোক। এখানে ডাক্তারী পড়ছেন।নূর ভাই এবং ডা. জায়েদুল হাসান তাঁকে আমার সঙ্গে পরিচয় করে দেন। হারিছ আলী হেসে বললেন, ‘আমিই আপনার রুবি।’ আমি বললাম, ‘তাই বলেন। আপনি পুরুষ’। বললেন, ‘আমি পুরুষ। আপনার টেলিফোন আমিই ধরেছি। এজন্যে মাপ করবেন।’ আমি বললাম, ‘ভালই হয়েছে। বাংলার ডাক আমি একা লেখি। মুকুল নামে আরেকজন লোক ছিলেন।তিনি এখান থেকে চলে গেছেন পোর্টসমাঊথে না কোথায়। আপনি আমাকে একটু হেল্প করবেন?’ হারিছ আলী এই যে হেল্প করা শুরু করলেন আর থামাথামি নাই। রাতদিন তিনি লেখালেখি করা, হেডিং লেখা, এটা করা, সেটা করা ইত্যাদি সবকিছু করতে লাগলেন।এমনকি কাগজ প্যাক করা।’তারপর একদিন জানা গেল, জিয়াঊর রহমান লন্ডনে আসবেন এবং রাসেল স্কোয়ারের একটা হোটেলে ঊনি বক্তৃতা দেবেন। তখন হারিছ আলী বললেন, ‘জিয়ার বিরুদ্ধে বিক্ষোভ দেখাতে হবে’। আমি বললাম, ‘আমাদের লোক কোথায় যে আমরা বিক্ষোভ দেখাব?’ হারিছ বললেন, ‘আমরা যতজনই আছি! এমনকি ৪/৫ জন হলেও বিক্ষোভ প্রদর্শন করব।’ তো আসলে ৪/৫ জন না, আমরা জনাত্রিশেক লোক বিক্ষোভে অংশ নিয়েছিলাম। নুর ভাইও ছিলেন। আমাদের সাহিত্যিক বন্ধু আবদুল মতিনও সেখানে ছিলেন। তিনি আমাদের বড় ভাইয়ের মতো। আমরা তাঁকে মতিন ভাই ডাকতাম। তিনি সম্প্রতি মারা গেছেন। তাজুল ইসলাম নামে একটি ছেলে ছিল। সে ভয়ানক ‘যোদ্ধা’ (ফাইটার) ছিল। তারপরে আমাদের মোশতাক কোরেশী ছিলেন। অনেকেই সেখানে ছিলেন। জিয়াঊর রহমান যখন হোটেলে ঢুকবে, তখন তাজুল তাকে লক্ষ্য করে জুতা নিক্ষেপ করেছিল। সেখানে পুলিশ ছিল। তারপর বিএনপির এত লোক! এর মধ্যে সাহস করে জুতা মেরেছিল। পুলিশ এসে তাকে অ্যারেস্ট করে। ওকে এবং আরও একজনকে বোধ হয় অ্যারেস্ট করেছিল।দ্বিতীয়জনের নাম মনে নেই। জিয়াঊর রহমান আর মিটিং করেনি। খুবই কাঊয়ার্ড ছিল জিয়াঊর রহমান। নামে জেনারেল। কিন্ত্ত আসলে সাহস ছিল না। আমাদের বিক্ষোভ দেখে মিটিং করে নাই। হোটেল থেকে চলে গিয়েছিল। পুলিশ পরে তাজুলকে ছেড়ে দেয়। সেই বিক্ষোভে ডা. হারিছ আলী ছিলেন সবচাইতে ‘ঊগ্র’ (যুদ্ধংদেহী)’ । দেখলাম, ঊনি পারলে জিয়াঊর রহমানকে নিজেই মারেন। পুলিশ লাঠিচার্জ করে। মতিন ভাইসহ আমরা কজন দৌঁড়ে চলে যাই। ওই সময় মতিন ভাই চশমা হারান। হারিছ আলীর পায়ের গোড়ায় লাঠির বাড়ি লাগে। তিনি একটু আহত হন। তো সেদিন আমি দেখলাম, হারিছ আলী মানুষটা ছোটখাটো কিন্ত্ত অসম্ভব সাহসী। বারবার জিয়াঊর রহমানের দিকে ছুটে যান। এরপর আমাদের আওয়ামী লীগে একটা ভাঙ্গন ধরল। ভাঙ্গনটা হল যে, ওই সময় আওয়ামী লীগ পুনরুজ্জ্বীবিত হয়। এবং গৌস খান যিনি আগে সভাপতি ছিলেন, তার নেতৃত্বে একটা গ্রুপ তৈরি হয়। কিন্ত্ত আমরা একদল তখনও বাকশালের আদর্শ ধরে রেখেছি। হারিছ আলী বললেন, ‘বাকশালই করব আমরা।’ সুতরাং যুক্তরাজ্যে আওয়ামী লীগের পাশাপাশি বাকশালও থাকল। হারিছ আলী, নুর ঊদ্দিন আহমদসহ আরও অনেকে বাকশালে কাজ চালিয়ে গেলেন। তাছাড়া অনেকে বাকশালে ছিলেন যেমন লুটনের মুহিবুর রহমান। আরও কিছু লোক বাকশালে যোগ দিলেন। একটা শক্তিশালী গ্রুপ ছিল আমাদের। ‘বাকশাল সংগ্রাম পরিষদের’ সভাপতি ছিলেন মুহিবুর রহমান। সেক্রেটারী ছিলেন এবিএম ইসহাক। সুলতান মাহমুদ শরীফও ছিলেন। আমাদের তখন বসার জায়গা ছিল দুটো। একটা নুর ঊদ্দিন আহমদের ‘সাংরিলা’, অন্যটি টয়েনবী হল যেখানে ডা. হারিছ আলী বাস করতেন। এবং ‘বাংলার ডাক’ বের হবার পর এই বিরাট কাগজের বস্তা রাখি কোথায়? এই বস্তা তখন শফিকুর রহমান চৌধুরীর বড় ভাই আতাঊর রহমান চৌধুরীর রেস্টুরেন্টে রাখতাম। ওই রেস্টুরেন্টটি বোধ হয় আজও আছে মিডলসেক্স স্ট্রীটে।ওইখানে আমরা আশ্রয় নিলাম। কিন্ত্ত কিছুদিন পরে আতাঊর রহমান চৌধুরী আমাদেরকে আর তার রেস্টুরেন্ট ব্যবহার করতে দেননি। এখন কোথায় যাই! এই সময় হারিছ আলী বললেন, ‘আমার এক ভাগ্নি জামাই আছে। নাম জাবেদ আলী। এখানে ব্রিকলেনে তার চামড়ার ফ্যাক্টরি আছে (টেইলারিং শপ)। সেখানে গিয়ে ঊঠব।’ জাবেদ আলীর ফ্যাক্টরীতে চামড়া কাটার কাজ। সেটা দিয়ে বড় বড় কোট তৈরি করেন। জাম্বো কোট, নরমাল কোট ইত্যাদি।জাবেদ আলী তার ফ্যাক্টরীতে বহু লোককে চাকরি দিয়েছিলেন। একটা জাম্বো কোটের চামড়া কাটলে ৫০ পেনির মতো পাওয়া যেত। ওই কাজ করে বেশ টাকা রোজগার করা যেত। ওই ফ্যাক্টরিতে আমাদের মুকুলও (স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্রের ‘চরমপত্রখ্যাত’ এমআর আখতার মুকুল) কাজ করেছেন। হারিছ আলীই সেই ব্যবস্হা করেছিলেন। মুকুল তখন অর্থাভাবে ছিলেন। জাবেদ আলী তাকে চাকরি দিয়েছিলেন। হারিছ আলীও ওখানে মাঝেমধ্যে কাজ করতেন। কিন্ত্ত টাকা পয়সা জমাতে পারতেন না। অল্পস্বল্প যা কামাতেন তা দলের এবং ‘বাংলার ডাকের’ কাজে ব্যয় করে ফেলতেন; যেমন ধরুন বাংলার ডাক গ্রাহকদের কাছে পোস্টে পাঠাতে হবে। পয়সা নাই। কে দেবে পয়সা? হারিছ আলী। দেখা গেল ঊনি তাঁর নিজের পয়সা দিয়ে ডাকটিকিট কিনলেন। তারপর বাংলার ডাক পাঠকদের কাছে পোস্ট করলেন। তখন তাঁর নিজেরই খাওয়াদাওয়ার ঠিক -ঠিকানা ছিল না। ওই তাঁর ভাগ্নি আনোয়ারা খানমের বাসায় বা কোনও আত্মীয়স্বজনের বাসায় খাওয়া-দাওয়া করতেন। এবং সারাদিন এই ‘বাংলার ডাকের’ ও দলের কাজে লেগে থাকতেন। তারপরে হারিছ আলী যে কাজটা করেছেন এবং যেটা বড় কাজ, সেটা হল যুক্তরাজ্যে আওয়ামী যুবলীগের প্রতিষ্ঠা। হারিছ আলী এই প্রস্তাবটা দেন। এবং শেখ হাসিনা ও শেখ রেহানার সম্মতি নিয়ে যুক্তরাজ্যে ১৯৭৯ সালে আওয়ামী যুবলীগের প্রতিষ্ঠা করেন। আরজ আলী, শাহাব ঊদ্দিন আহমদ বেলাল, আমির হোসেন, সুরজ আলীসহ আরও অনেক তরুণকে ডেকে এনে তিনি যুবলীগকে দাঁড় করান। এরপরে একদিন চিফ জাস্টিস বিএ সিদ্দিকী লন্ডনে আসলেন। আমরা জানতামও না। আমরা হিথ্রো এয়ারপোর্টে গিয়েছি নিজেদের কোনও কাজে। আমি হারিছ আলী, ডা. জায়েদুল হাসানসহ কয়েকজন। বিএ সিদ্দিকী তখন প্লেন থেকে নেমে আসেন। এই লোক ‘৭১এ টিক্কা খানের সঙ্গে হাত মিলিয়ে গভর্নরকে শপথপাঠ করিয়েছিলেন। তো এয়ারপোর্টে বিএ সিদ্দিকীর সঙ্গে হঠাৎ করে আমাদের দেখা হয়ে যায়। ঊনি আমাদেরকে বাঙালি মনে করে এগিয়ে আসেন। হাত মেলানোর জন্যে বাড়িয়ে দেন আমাদের দিকে। হারিছ সামনে ছিলেন। তাই তাঁর দিকেই প্রথমে হাত বাড়ান। তখন হারিছ ক্রুদ্ধ হয়ে বিএ সিদ্দিকীকে বলেন, ‘shame on you’. একথা বলে তাঁর হাত সরিয়ে নেন। হারিছের দেখাদেখি আমরাও হাত সরিয়ে নিয়েছিলাম। চিফ জাস্টিস সাহেব তো অবাক হয়ে যান। ভাবছেন, কী হল! অবশ্য পুলিশ এসে তাঁকে আমাদের সামনে থেকে সরিয়ে নেয়। এরপর আমি হারিছ আলীকে বললাম, ছোটখাটো শরীর নিয়ে আপনি যেরকম দুর্দান্ত সাহসী কাজ করেন! মনে হচ্ছে, আপনি একদিন আওয়ামী লীগের বড় নেতা হবেন। এরপর যুক্তরাজ্যে আওয়ামীলীগ-বাকশাল একত্র হয়ে যায়।আবদুল মালেক ঊকিল সাহেব লন্ডনে আসেন। তিনি আওয়ামীলীগ এবং বাকশাল দুটোকে এক করে দেন।ইতিমধ্যে দেশেও আওয়ামীলীগ আবার পুনরুজ্জীবিত হয়েছে। মালেক সাহেব সভাপতি নির্বাচিত হয়েছেন। ওই সময়ই মালেক সাহেব লন্ডনে আসেন।তখন বেকার স্ট্রিটে ছিল আতাঊর রহমান খানের ‘রাজদূত’ রেস্টুরেন্ট। মালেক সাহেব সেখানে মিটিং করলেন। সকলকে ডাকলেন। যুক্তরাজ্য আওয়ামীলীগ এবং বাকশালকে এক করে দিলেন।ওই সভায় আবদুস সামাদ আজাদ বক্তৃতা দিয়েছিলেন। মালেক ঊকিল তো ছিলেনই। সেই সভার সিদ্ধান্ত মোতাবেক হারিছ আলীকে সাংগঠনিক ভার দেওয়া হয়েছিল। আহবায়ক করা হয়েছিল। এভাবে যুক্তরাজ্যে আওয়ামীলীগ এবং বাকশাল একত্র হয়ে আওয়ামীলীগ পুনর্গঠিত হয়। তারপর শেখ হাসিনা লন্ডনে আসেন। শেখ হাসিনার সঙ্গে হারিছ আলী পরিচিত হন। এবং অল্প দিনের ভেতরেই শেখ হাসিনার ঘনিষ্ঠ হয়ে যান। তখন সিদ্ধান্ত হয় বেথনাল গ্রিনের বিখ্যাত ইয়র্ক হলে শেখ হাসিনা মিটিং করবেন। প্রথম রাজনৈতিক সভা করবেন। তারিখ নির্ধারণ করা হয় ১৯৮০ সালের ১৬ আগস্ট।ওই সভার সব ইস্তেহার হারিছ আলীর লেখা। এবং হাসিনা তখন বলেছিলেন, ‘আমি যে ইয়র্ক হলে বক্তৃতা দেব, মানুষ কতজন আসবে? এখানে তো বিএনপির লোক আছে, জামাতের লোক আছে। কতজন বাঙালিকে আনা যাবে?’ হারিছ আলী বললেন, ‘আপা, আমি হল ভরে দেবো।’ এবং সত্যি তাই হয়েছিল। ইয়র্ক হল ভরতি হয়ে লোক ঊপচে পড়ছিল। তারপর তো হারিছ আলী বাংলাদেশে ফিরে গেলেন। বললেন, ‘দেশে গিয়ে পলিটিক্স করব।’। আমি তাঁকে জিজ্ঞেস করলাম, ‘আগামীতে নির্বাচনে দাঁড়াবেন? নির্বাচন করতে গেলে তো পয়সা লাগবে’। বললেন, নির্বাচনে দাঁড়াবেন। এ-ও বললেন, ‘পয়সাকড়ি নাই! তবে আমার ছাতকবাসীরাই আমাকে পয়সা দেবে। হারিছ আলী দেশে চলে যাওয়ার পরও, খুব কাছাকাছি না, মানে, মাসে একবার দু’বার তাঁর চিঠি পেতাম। লিখতেন যে দেশে তিনি আওয়ামীলীগ করছেন। ছাত্রলীগ-যুবলীগের ছেলেদের ঊৎসাহ দিচ্ছেন। নিজে ডাক্তারী প্রেকটিস করেন। খবর নিয়ে জানলাম, অল্পস্বল্প যা পয়সা পান তা-ও মানুষকে দিয়ে দেন, দলের ছেলেদের জন্য খরচ করে ফেলেন। তারপর, দ্বিতীয় একটা বিয়ে করেছেন, তা-ও জানালেন। এইভাবে চলছিল। এরপর ইলেকশন আসলো। সম্ভবত ১৯৮৬ সালের নির্বাচন। আমি তখন লন্ডনে একদিন শেখ হাসিনাকে জিজ্ঞেস করলাম, ‘আমাদের হারিছ আলী কী নমিনেশন পাবেন? ঊনি হ্যাঁ বা না কিছু বললেন না। কিন্ত্ত তাঁর ভাব দেখে মনে হল, ডা. হারিছ আলীর কথা জিজ্ঞাসা করেন কেন? ঊনি তো নমিনেশন পাবেই!’ কারণ তখন তাঁর চাইতে আওয়ামীলীগপন্থী আর বড় কেঊ ছিল না। কিন্ত্ত নমিনেশনের তালিকা প্রকাশের পর দেখা গেল হারিছ আলীর নাম নেই! আমার খুব দু:খ হয়েছিল। যে লোকটি লন্ডনে আওয়ামীলীগকে তাজা করেছে, চাঙ্গা করেছে, যুবলীগ প্রতিষ্ঠা করেছে, আমাদের ‘বাংলার ডাক’ পত্রিকা প্রকাশে কাজ করেছে, ঘরে ঘরে বাংলার ডাক পৌঁছে দেওয়ার ব্যবস্হা করেছে, দলের জন্যে টাকা তুলেছে; যে লোকটি যুক্তরাজ্য আওয়ামীলীগের সাংগঠনিক প্রতিষ্ঠাতাদের একজন, তাঁর কোনও মূল্যায়ণ হয়নি। এখনও তাঁর মূল্যায়ণ হচ্ছে না। এটা আমার দু:খ। হারিছ আলী মারা যাওয়ার পর তাঁর যেসব সঙ্গী-সাথী-অনুচর আজকে জীবনে প্রতিষ্ঠা লাভ করেছেন, তারা হারিছ আলীকে স্মরণ করেন না। আমি শুনেছি, তিনি ছাতকের জাঊয়ায় যে কলেজ প্রতিষ্ঠা করেছেন তাতেও তাঁর মৃত্যুদিবসে শোকসভা হয় না। ঊপজেলা চেয়ারম্যান ফজলুর রহমান সাহেব আছেন। তিনি তো এককালে হারিছ আলীর খুবই ঘনিষ্ঠ ছিলেন। কিন্ত্ত ঊপজেলার গুরুত্বপূর্ণ স্হানে বা পয়েন্টে হারিছ আলীর স্মৃতি রক্ষার জন্যে কিচ্ছু হয়নি। বর্তমান মেয়র আবুল কালাম চৌধুরী, তিনিও তো ডা. হারিছ আলীর খুবই ঘনিষ্ঠ ছিলেন। ঊনি এইখানে (অনুষ্ঠানে) আছেন? তাঁকে আমার জিজ্ঞাসা, বিনীত জিজ্ঞাসা, তিনি, তাদের যে কৃতী সন্তান, ছাতকের যে কৃতী সন্তান, যিনি স্বাধীনতা পুরস্কার পেয়েছেন তাঁকে কেন তাঁর ঊপযুক্ত ‘স্বীকৃতি ও মর্যাদা’ দিচ্ছেন না? রাষ্ট তাঁকে সম্মান দিয়েছে, অথচ তাঁর জেলা, তাঁর এলাকা তাঁকে সম্মান দেয় না! এইটা খুব দু:খজনক। আমি মেয়রকে বিনীতভাবে অনুরোধ করব, ছাতকে গোবিন্দগন্জ পয়েন্ট বলে যে জায়গাটা আছে, যে স্কোয়ার আছে, যেখানে গোলচত্বর নির্মাণ করা হচ্ছে, অন্তত তার নামকরণটা যেন হারিছ আলীর নামে নামকরণ করা হয়। তাছাড়া হারিছ আলীর প্রতিষ্ঠিত কলেজটির নামও হারিছ আলী কলেজ করা হোক। এটা আমার এমপি মুহিবুর রহমান মানিক, ঊপজেলা চেয়ারম্যান ফজলুর রহমান, মেয়র আবুল কালাম চৌধুরীর কাছে বিনীত নিবেদন।হারিছ আলী মারা গেছেন। তাঁর এক যোগ্য পুত্র সিলেটের ইতিহাস ইংরেজ লেখকদের বই থেকে অনুবাদ করে কয়েকটি বই প্রকাশ করেছে। এবং একটি দু:সাহসিক এৌতিহাসিক কাজ করেছে তাঁর ছেলে। তাঁরও কোনও মূল্যায়ণ হচ্ছে আমার মনে হয় না।আপনারা আমাকে ডেকেছেন হারিছ আলী সম্পর্কে কথা বলতে। কথা বলতে পারি। কিন্ত্ত যেটা আমার বলার কথা, হারিছ আলী চলে গেছেন; শাহজালালের মাজারে তাঁর কবর দেওয়া হয়েছে। কিন্ত্ত তাঁর স্মৃতি রক্ষার ব্যবস্হা হয়নি। মেয়র আবুল কালাম, ঊপজেলা চেয়ারম্যান ফজলুর রহমান সাহেব এবং সর্বোপরি আমাদের এমপি মানিক সাহেবের কাছে আমার একান্ত অনুরোধ, হারিছ আলীর স্মৃতি রক্ষার জন্যে তাঁরা যেন আন্তরিক ঊদ্যোগ নেন। যিনি স্বাধীনতা পদক পেয়েছেন, তিনি তাঁর এলাকায় আদৃত হবেন না, এটা লজ্জ্বাজনক। এই বলে আমি শেষ করছি। হারিছ আলী আমাদের মাঝে আছেন। তিনি দীর্ঘজীবি হয়ে থাকবে। গুণী মানুষ ছিলেন, তিনি মারা যাবেন না। ছাতকে ও ঊন্নতি হচ্ছে। এই ঊন্নয়নের পেছনে তাঁর অবদান আছে। আবারও হারিছ আলীর স্মৃতির প্রতি শ্রদ্ধা নিবেদন করে আমার বক্তব্য শেষ করছি।
জয় বাংলা
জয় বঙ্গবন্ধু।
Leave a Reply