ছাতকের পীরপুর বাজার উন্নয়নের
সিংহভাগ অর্থসহ লুটপাটের অভিযোগ
স্টাফ রিপোর্টার, ছাতক
সুনামগঞ্জের ছাতকে বাজার উন্নয়নের নামে সরকারী বরাদ্দের অর্থ লুটপাটের অভিযোগ উঠেছে। শুধু বাজার উন্নয়নের নয়, বাজারের ১৮টি বিভিন্ন ধরণের গাছ বিক্রির ও মসজিদের টাকা ভাগবাটোয়ারা করে নেওয়া হয়েছে। উপজেলার গোবিন্দগঞ্জ-সৈদেরগাঁও ইউনিয়নের পীরপুর হাটবাজার ব্যবস্থাপনা কমিটির বিরুদ্ধে এমন অভিযোগ করেছেন ব্যবসায়ী ও স্থানীয় এলাকাবাসী। যার নেপথ্যে রয়েছেন স্থানীয় এক আওয়ামী লীগ নেতা ও তার সহযোগীরা।
উপজেলা প্রশাসন ও স্থানীয় তথ্যমতে, ২০২১ সালে ৩ বছরের জন্য পীরপুর হাটবাজার ব্যবস্থাপনা কমিটি গঠন করা হয়েছিল। এতে হাফেজ রুহুল আমিন চৌধুরীকে সভাপতি ও আলাউদ্দিনকে সেক্রেটারী করে ১৪ সদস্যের এ কমিটি মেয়াদকালে পীরপুর বাজারের উন্নয়নের জন্য ৪২ লাখ টাকা বরাদ্দ হয়। বরাদ্দের খবর পেয়ে ক্ষমতার অপব্যবহার করে ২নং ওয়ার্ডের সাবেক মেম্বার ও ইউনিয়ন আওয়ামীলীগের সাহিত্য ও জনসংখ্যা বিষয়ক সম্পাদক, মল্লিকপুর গ্রামের বাসিন্দা রাজন আহমদ তালুকদারসহ স্থানীয় প্রভাবশালী একটি চক্র কমিটির বিরোধিতা শুরু করে। এক পর্যায় দলীয় ক্ষমতার দাপুট আর এলাকার আধিপত্য বিস্তার করে মখলিছুর রহমানকে সভাপতি, রাজন আহমদ তালুকদারকে সহসভাপতি ও আবুল বশরকে সেক্রেটারী করে তারা পীরপুর হাটবাজার ব্যবস্থাপনা নামে নতূন একটি কমিটি গঠন করে। যার মুল নেপথ্যে ছিলেন রাজন। তার বিরুদ্ধে হত্যা, শ্লিলতাহানী, নারী নির্যাতন, প্রতারণাসহ বিভিন্ন ধারায় প্রায় দেড় ডজন মামলা রয়েছে। এমনকি সাবেক কমিটির সেক্রেটারী আলাউদ্দিন বাদি হয়ে রাজন তালুকদারসহ ৭জনের বিরুদ্ধে সুনামগঞ্জ আদালকে একটি স্বত্ব মোকদ্দমা নং-৩৭/২০২২ দায়ের করেন।
সরজমিন আলাপ করে জানা যায়, সম্প্রতি উপজেলা এলজিইডির মাধ্যমে পীরপুর বাজার উন্নয়নের জন্য ৪২ লাখ টাকা বরাদ্দ হয়। এ বরাদ্দ দিয়ে বাজারের দুই গলি পাকা সংস্কার কাজ, সব্জির ও মাছের জন্য দুটি টিনসেডের ঘর নির্মাণ করেন মখলিছ, রাজন ও আবুল বশরের নেতৃত্বাধীন কমিটি। পাশাপাশি বাজারের গলির পাশে ব্যবসায়ীদের চাঁদায় রোপন করা ২৫-৩০ বছর বয়সী প্রায় ১৮টি বিভিন্ন প্রজাতির গাছ বিক্রি করেন তারা। বাজারের ভিটা ক্রয়-বিক্রয় থেকে মসজিদে দানের লক্ষাধিক টাকাও তারা ভাগবাটোয়ারা করে নিয়েছেন।
সরেজমিন দেখা গেছে রাজন আহমদ তালুকদার ব্যবসায়ীদের সরিয়ে জোরপূর্বক বাজারের ভিটা দখল করে বাঁশ দিয়ে দোকান কোঠা নির্মাণ করেছেন। ভিটা ফিরিয়ে দেওয়ার নামে এক ব্যবসায়ীর কাছ থেকে ৫ হাজার টাকা চাঁদা দাবি করেন তিনি। ইতোমধ্যে ৩ হাজার টাকা চাঁদা নিয়ে তিনি ভিটেও ছাড়েননি। ব্যবসায়ী আলাউদ্দিন বলেন, পীরপুর হাটবাজার ব্যবস্থাপনা কমিটির বৈধ সেক্রেটারী তিনি ছিলেন। ক্ষমতার দাপুটে অবৈধভাবে রাজন গংরা নতূন কমিটি গঠন করে বাজার উন্নয়নের নামে ১৪-১৫ লাখ টাকা কাজে ব্যয় করে সরকারী বরাদ্দের ২৭ লাখ টাকা আত্মসাত করা হয়েছে। এছাড়া বাজারের গাছ বিক্রির দেড়লাখ, বাজারের মসজিদের এক লাখ টাকা তারা ভাগাভাগি করে নিয়েছেন। বাজারের ব্যবসায়ীকে জোর পূর্বক ভিটে থেকে তুলে রাজন ও তার ছেলে মিলে একটি ভিটায় জোরপূর্বক দোকান ঘর তৈরি করেছেন। তিনি আরও জানান, ক্ষমতার দাপট দেখিয়ে তার খরিদা জায়গায় মাছ বাজারের ঘর নির্মাণ করেছে বাজারের এ অবৈধ কমিটি।
এলাকার বাসিন্দা আবদুর রহমান বলেন, সরকারী বরাদ্দের সামান্য কাজ করে বাকি টাকা কোথায় গেল, এটি নিরপেক্ষ তদন্তের মাধ্যমে বের করা হউক। বাজারের মাছ ব্যবসায়ী হুশিয়ার আলী বলেন, তিনি অনেক কষ্ট করে জীবন জীবিকা নির্বাহ করে আসছেন। ৩ মাস আগে রাজন তালুকদার তার কাছ থেকে ১৮০ টাকার মাছ নিয়েছিল, কিন্তু আজ পর্যন্ত টাকাগুলো দেন নাই।
নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক একজন সংবাদকর্মী বলেন, রাজন তালুকদার সম্প্রতি শ্লিলতাহানী একটি মামলায় জেলে ছিলেন। উচ্চ আদালত থেকে জামিন আনার জন্য ওই সংবাদকর্মীর কাছ থেকে ২৫ হাজার টাকা ধার নেন। কিন্তু আজ পর্যন্ত টাকা পরিশোধ করেননি। রাজাউর রহমান বলেন, সরকার এতো টাকা দিলো কিন্তু বাজারের দুই গলির পুরো রাস্তা পাকা করা হয়নি কেন বিষয়টি তদন্ত করে দেখা প্রয়োজন। তাছাড়া কাজগুলোও টেকসই হয়নি। রইছ আলী বলেন, গাছগুলো বাজারে আগত মানুষদের ছায়া ও অক্সিজেন দিতো, অর্থ আত্মসাতের জন্য অহেতুক গাছগুলো বিক্রি করা হয়েছে। ব্যবসায়ী আবদুস সালাম বলেন, বাজারের পূরাতন মাছের ঘরটি সংস্কার করে নিলেই চলত। এমনিতেই বাজারে টিউবওয়েল ও টয়লেট নেই, এগুলোর দিকে নজর দেওয়া প্রয়োজন ছিল। ডিপ টিউবওয়েলটি স্থাপনের পর অকেজু হয়ে পড়ে আছে। মসজিদের পানি বাজারের ব্যবসায়ীরা ব্যবহার করছেন।
বাজার মসজিদের মোতাওয়াল্লি নুর হোসেন ও সেক্রেটারী রহিম উদ্দিন বলেন, পূর্ব থেকে নিয়ম রয়েছে বাজারের ভিটা ক্রয়-বিক্রয় হলে উভয় পক্ষ বাজার মসজিদে ১০হাজার টাকা দান করতে হতো। সেই নিয়ম অনুযায়ী মসজিদের লাখ টাকার মতো পাওনা রয়েছে এ কমিটির কাছে। তারা মসজিদের টাকা পরিশোধ করছেন না। গাছের ক্রেতা পাশ্ববর্তী হাইলকেয়ারি গ্রামের ব্যবসায়ী লুৎফুর রহমান বলেন, গাছের একটি ডাল মাছবাজারের ঘরের টিনে পড়ায় তার কাছ থেকে ওই রাজন হুমকি-ধামকি এবং ভয় ভিতি দেখিয়ে নগদ ৩৫ হাজার টাকা জরিমানা হিসেবে আদায় করেছেন। ২নং ওয়ার্ডের মেম্বার শায়েস্তা হোসেন তালুকদার বলেন, ৪২ লাখ টাকা বরাদ্দ হলে এখানে প্রায় ১৫-১৬ লাখ টাকার কাজ হয়েছে বলে আমাদের ধারণা। কিন্তু বাকি টাকার কোন হদিস নেই। বিষয়টি খতিয়ে বের করা দরকার।
নাম প্রকাশ না করার শর্তে একাধিক ব্যবসায়ী ও বাসিন্দা জানিয়েছেন সরকার পতনের পর থেকে আওয়ামী লীগের কোন নেতা-কর্মীরা মাঠে নেই, সবাই আত্মগোপনে চলে গেলেও পীরপুর হাটবাজার ব্যবস্থাপনা কমিটির সহ-সভাপতি চাঁদাবাজ রাজন মেম্বার এলাকায় অবস্থান করছেন। বাজারে জুয়ার আসরসহ মাদক বিকিনির নেপথ্যে রয়েছেন তিনি।
এ বিষয়ে পীরপুর হাটবাজার ব্যবস্থাপনা কমিটির সভাপতি মখলিছুর রহমান, সহ-সভাপতি সাবেক মেম্বার রাজন তালুকদারের সাথে যোগাযোগ করা হলে তাদের মোবাইল ফোন বন্ধ পাওয়ায় বক্তব্য নেওয়া সম্ভব হয়নি। তবে সেক্রেটারী আবুল বশরের মোবাইল ফোনে যোগাযোগ করা হলে তিনি বলেন, সরকারী বরাদ্দ ৪০ লাখ টাকা দিয়ে গলি পাকা, পৃথক দুইটি মাছ ও সব্জির টিনসেডের ঘর নির্মাণ করা হয়েছে। অর্থ আত্মসাতের বিষয় সঠিক নয়। গাছ বিক্রির বিষয়ে উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা অবগত আছেন। মসজিদের অর্থের বিষয়ে জানতে চাওয়া হলে তিনি লাইন কেটে মোবাইল বন্ধ করে দেন।
Leave a Reply