আমার স্মৃতিতে কামাল পাশা- অধ্যাপক ডা. মো. উবায়দুল কবীর চৌধুরী
আল হেলাল::::
ভাটি অঞ্চলের বাউল গান, ভাটিয়ালি গান, কবি গান, জারি গান, পালা গানের জনশ্রুতি অতি সুপরিচিত। উর্বর পলিমাটি সমৃদ্ধ ভাটি অঞ্চলের মাটি অতি খাঁটি। তাতে প্রচুর ফল-ফসল জন্মে। এর মধ্যে ধান ও পাট অন্যতম। তবে আম কাঁঠালেরও কমতি নেই। গোলাভরা ধান, হাওরভরা মাছ, ঘরভরা হাঁসমুরগী, গোয়ালভরা গরু, কি সমৃদ্ধি ছিল ভাটি অঞ্চলের। ছয় মাস কৃষি কাজ। কঠোর পরিশ্রমের ফসল ফলানোর সংগ্রাম, ত্যাগ-তিতিক্ষা। শ্রমের ফসল ঘরে তোলার পালা বৈশাখে। নতুন ধান ঘরে তোলাকে কেন্দ্র করে নবান্নেরও উৎসব হয় এই মাসে। আম কাঁঠালের সমারোহ, রসে ভরপুর ফলফলাদি।
জ্যৈষ্ঠের আগমনে আকাশে মেঘের ঘনঘটা, বৃষ্টির বারতা। শুরু হয় আষাঢ়ের গর্জন ও বর্ষণ আর অথৈ পানি আর পানি। মাঠ-ঘাট, খাল-বিল, নদী-নালা, ধানি জমি সব পানিতে তলিয়ে যায়। হাওর আর শুকনো জমি সব পানিতে একাকার। অকুল সাওর পাড়বিহীন পানি আর পানি। দীপাঞ্চলের মতো ভেসে থাকে বসত ভিটা। শুরু হয় অবসরের পালা, তারই সঙ্গে মাদল বাজে, শুরু হয় জারি গান, ভাটিয়ালি গান আর যাত্রার সমারোহ।
কি আনন্দ, কি সুর, কি সমৃদ্ধি। তার মাঝে ভেসে আসে সুরের মূর্ছনা। বাঁশের বাঁশির হৃদয় স্পর্শ করা অপরুপ সুর। আর এই সুরের তালেই জন্ম নেন ভাটি অঞ্চলের মুকুটহীন সংগীত রচয়িতা, সুরকার গায়ক,সাধক,বাউল সম্রাট কামাল উদ্দিন। যার নামের বিস্তৃতি ও প্রসিদ্ধি কামাল পাশা নামে। গ্রামের নাম ভাটিপাড়া, যার অর্থ পানির মাঝে পাড়ের বসতি পাড়া। আমার স্মৃতি বিজড়িত জন্মস্থান। মধুময় স্মৃতি চারণভূমিতে, সুখ সমৃদ্ধিতে ভরপুর এই সোনার ভাটিপাড়া। ছেলেবেলায় কামাল পাশার অনেক গান শুনেছি।
সারি সারি দালান আছে
মসজিদ আছে খাড়া
আমার সোনার ভাটিপাড়া।
কামাল পাশা ছিলেন সাধক গায়ক, যিনি নিজেই তাৎক্ষণিক গান রচনা করতেন। কোনো বাদ্যযন্ত্র ছাড়াই অপূর্ব সুরের মূর্ছনায় গাইতেন তার স্বরচিত গান। সম্মোহন করতেন ছাত্র জনতাকে। তিনি বসতে, হাঁটতে, চলতে গাইতেন গান। কামাল পাশা গেয়েছেন গান মাঠে, ঘাঠে,পথে, প্রান্তরে, জলে এবং স্থলে। গেয়েছেন গান পানসি নৌকায়, বজরা নৌকায়, গয়না নৌকায়, নৌকার বাইছে, দৌড়ের নৌকায়।
তার গানে আছে
“পান খাইয়া যাও ও মাঝি ভাই,
ঐ ঘাটে ভিরাইয়া তোমার নাও”
তার গানে আছে
“নাও বাইয়া যাওরে বাংলার মানুষ,যুক্তফ্রন্টের নাও,
নাও চলে আগে আগে, শেখ মুজিবের নাও,
মুজিব বাইয়া যাওরে কিনারায়
ভিড়বে তোমার নাও। ”
জাতীয় কবি, বিদ্রোহি কবি কাজী নজরুল ইসলামের আগমনে তিনি মঞ্চে গান গেয়েছেন। কামাল পাশার ছিল লম্বা লম্বা বাবড়ি চুল। যেমনটি ছিল নজরুলের ছন্নছাড়া জীবন, তেমনই জীবন ছিল কামাল পাশারও। অপূর্ব ছিল তার বাচনভঙ্গি। সম্মোহনী সুর ছিল তার গানে ও কথায়। তাৎক্ষণিক গান রচনায় অতুলনীয় পারদর্শিতা। তিনি গেয়েছেন মঞ্চে, সভা সমিতিতে, হোসেন শহীদ সোহরাওয়াদির্র মঞ্চে, বঙ্গবন্ধুর মঞ্চে। স্বরচিত গানে মুগ্ধ করেছেন নেতা-জনতাকে। কৈশোরে শুনেছি তার গান, শুনেছি যৌবনে।
প্রেমের মরা জলে ডুবে না
যে প্রেম গড়তে দুইদিন
ভাঙ্গতে একদিন
এমন প্রেম আর কইরনা রে সজনি।
১৯৩৭ সালে নানকার আন্দোলন,৪৭-এ সিলেট রেফারেন্ডাম, ৫২-র ভাষা আন্দোলনে, ৫৪-র যুক্তফ্রন্টের নির্বাচনে, ১৯৬৬ সালে আইয়ুব বিরোধী আন্দোলনে,৭০-এর দশকে এমএনএ ও এমপিএ নির্বাচনে সর্বোপরী ৭১ এর মুক্তিযুদ্ধে শুনেছি প্রচুর গান কবি কামালের মুখে। ৭০-এর দশকে তদানিন্তন পাকিস্তানের শেষ নির্বাচনে গেয়েছেন বঙ্গবন্ধুর জয়গান। জয়তালি-করতালিতে হর্সিত, মুখরিত হয়েছে বাংলার ভাটি অঞ্চল। মুখরিত মনমাতানো জনগণ জনমতের গান গেয়েছেন, ৭১-এ মুক্তিযুদ্ধের সময় তিনি গেয়েছেন মুক্তিযুদ্ধের গান।
পল্লীকবি কামাল চলে জয় বাংলা জয় বাংলা বলে
ছাড় নৌকা পাল তোলে,ভয় নেই বোমা বুলেটের ॥
ঐ নৌকাটা শেখ মুজিবের।
গান গেয়েছেন মুক্তির। ভাটি পাড়ার মাঠে ঘাটে সংগ্রামী গান। পরে তিনি চলে যান টেকেরঘাটে মুক্তিযুদ্ধা শিবিরে। গান গেয়ে মাতিয়েছেন বীর মুক্তিযোদ্ধাদের। আমার স্মৃতিতে আজও তা উদ্ভাসিত। তিক্ষè অপূর্ব স্মৃতিশক্তি ছিল তার। আগে না লিখে,আগে না পড়ে,আগে না চিন্তা করে তিনি রচনা করেছেন অসংখ্য গান। তিনি গেয়েছেন অসংখ্য গান, যাত্রার পালা অনুষ্ঠানে গান গেয়েছেন। প্রারম্ভিক গান গেয়েছেন বিভিন্ন সভা সমিতিতে। এমন মেধা, সাধক, গায়ক আমি এর আগে খুব কম দেখেছি। অপূর্ব মেধা ছিল তার। দেশপ্রেম, দেশাত্মবোধ, জাতির জন্য, দেশের জন্য, জনগণের জন্য গানে গানে জীবনের ৭০ বছর বিলিয়ে দিয়েছেন। তিনি গেয়েছেন আনন্দের গান, জয়ের গান, মানব বন্ধনার গান, জাতি-জাগরণের গান, পরিশেষে তিনি গেয়েছেন অশ্রুসিক্ত নয়নে মুজিব পরিবারের প্রয়ানের গান হৃদয় দিয়ে, মন দিয়ে অন্তরের গভীরতম অনুভতি দিয়ে। যে গানে অশ্রু ধরে রাখতে পারেনি আমজনতা।
এই সাধক বাউল কবি গেয়েছেন হৃদয়ের গান, রাজনীতির গান, মুক্তির গান, মরমি গান। সহস্র স্বরচিত গান তিনি নিজেই গেয়েছেন কিন্তু লিখতে পারেননি। অবহেলিত পাড়া গায়ে জন্ম তার,লালনের মতো প্রতিভা ছিল কিন্তু আজ তা অন্ধকারে নিমজ্বিত। তার গান, লিখিত বই-কবিতা আর নাই। তার অসংখ্য গান কবিতা লোকালয়ে লোকগীতি হিসাবে পরিচিত। তিনি ছিলেন চলমান কবি, ধাবমান কবি, শক্তিমান কবি।
গানের ছন্দে কেটেছে তার জীবন। লিখে যাননি কোনো পুস্তক,তার জীবন আলেখ্য। বর্তমান প্রজন্মের প্রতি আহবান ভাটি অঞ্চলের এই ক্ষণজন্মা সাধক সংগীত লিপিকার কামাল পাশাকে আপনারা আবিস্কার করে জাতির সম্মুখে উপস্থাপন করুন।
সক্রেটিস, এরিস্টটলের তেমন ছিল না বহু বই-পুস্তক, তেমন ছিলনা বহু রচনা। কিন্তু ছিল তাদের গবেষণা কর্ম, ছিল তাদের প্রজ্ঞা, ছিল তাদের জ্ঞান। পরবর্তীতে পরবর্তী প্রজন্ম বের করেছেন তাদের বই। তাদের সেই জ্ঞান, তাদের বুদ্ধি পৃথিবীতে আজও বিচরণ করছে। যার ফলে প্রজন্মের পরে প্রজন্ম আজ উপকৃত।
লালন শাহ এর গবেষণার মধ্যে উঠে এসেছে লালন শাহ -এর কথা। কবিগুরু লালনের সান্নিধ্যে আসার পর লালনের প্রসিদ্ধি লাভ হয়। লালনের ছিল ধ্যান, জ্ঞান, মর্মকথা ছিল তার গানে। আজ তিনি লালন শাইজি নামে পরিচিত। কে না জানে তার নাম। কারণ কোন একটা মাধ্যম লাগে কাউকে পরিচিত করতে। কবি গুরু করেছেন লালনকে পরিচিত। সাইজি বলে প্রসিদ্ধ তিনি। খ্যাতিমান সাধক বাউল গেয়েছেন লালনের গান, হাজারও অনুসারি রেখে গেছেন তিনি।
আশা করি কামাল পাশার সহ¯্র গানের মূর্ছনায় তৈরী হবে হাজারও অনুসারী। জনগনের মধ্যে বেঁচে থাকবেন ভাটি অঞ্চলের মুকুটহীন আধ্যাত্মিক বাউল মরমি কবি কামাল পাশা। কামাল পাশার স্বীকৃতি প্রয়োজন। আমি চাই কামাল পাশার স্বীকৃতি আসুক। কামাল পাশা ছিলেন অতুলনীয়, অভুলনীয়, অনস্বীকার্য, অনুপম মহিমায় মহামান্নিত এক মহাকবি।
আমি বাউল কামাল পাশা সংস্কৃতি সংসদ সুনামগঞ্জ সংগঠনের প্রতিষ্ঠাতা আহবায়ক,গবেষক,সাংবাদিক বাউল আল-হেলালের কাছ থেকে জানতে পারলাম,গত ৭ অক্টোবর ২০২০ইং সংস্কৃতি বিষয়ক মন্ত্রণালয়ের সচিব বরাবরে জেলা প্রশাসক মোহাম্মদ আব্দুল আহাদ বাউল কামাল পাশাকে মরণোত্তর একুশে পদক ২০২১ মনোনয়নের নিমিত্তে ৮ম বার প্রস্তাব প্রতিবেদন প্রেরণ করেছেন। এর আগে ৩০ সেপ্টেম্বর ২০১৯ইং সপ্তম বার, ১০ অক্টোবর ২০১৮ইং ষ্ষ্ঠ বার জেলা প্রশাসক মোহাম্মদ আব্দুল আহাদ কর্তৃক একই প্রস্তাব প্রেরণ করা হয়। ২ অক্টোবর ২০১৭ইং পঞ্চম বার, ১৯ নভেম্বর ২০১৪ইং চতুর্থ বার সাবেক জেলা প্রশাসক শেখ রফিকুল ইসলাম এবং গত ১৮ নভেম্বর ২০১৩ইং তৃতীয় বার,৮ নভেম্বর ২০১২ ইং দ্বিতীয় বার ও ২৩ নভেম্বর ২০১১ইং প্রথম বার সংস্কৃতি মন্ত্রণালয় এর সচিব বরাবরে অনুরুপ প্রস্তাব প্রেরণ করেন সাবেক জেলা প্রশাসক মুহাম্মদ ইয়ামিন চৌধুরী। জেলার ৩ জন জেলা প্রশাসক বিস্তারিত তথ্য উপাত্ত সহকারে বাউল কামাল পাশা (কামাল উদ্দিন) কে মরণোত্তর একুশে পদকে ভূষিত করার জন্য পর পর ৮বার প্রস্তাবনা প্রেরণ করলেও এখন পর্যন্ত জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে নিয়ে সর্বপ্রথম গণসংগীত রচয়িতা বাউল শিল্পী কামাল পাশা মরণোত্তর স্বীকৃতি পাননি।
আরো জানতে পেরেছি যে,গত ২৭ নভেম্বর ২০১৭ খ্রি: তারিখে মন্ত্রীপরিষদ সচিব বরাবরে জেলা প্রশাসক মো: সাবিরুল ইসলাম মরণোত্তর স্বাধীনতা পুরস্কার ২০১৮ইং ও ১৪ নভেম্বর ২০১২ খ্রি: তারিখে কমিশনার সিলেট বিভাগ বরাবরে অতিরিক্ত জেলা প্রশাসক (সার্বিক) খন্দকার অলিউর রহমান,মরণোত্তর স্বাধীনতা পুরস্কার ২০১৩ইং প্রদানের জন্য লিখিত প্রস্তাব প্রেরণ করেছেন। ১২/১২/২০১২ ইং তারিখে গণ প্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ সরকারের প্রধানমন্ত্রী বরাবরে জেলা আওয়ামীলীগ সভাপতি আলহাজ্ব মতিউর রহমান ও সাধারন সম্পাদক নুরুল হুদা মুকুট এবং মাননীয় সংসদ সদস্য এম.এ মান্নান মহোদয় এর যৌথ স্বাক্ষরিত স্বাধীনতা পুরস্কার ২০১৩ইং প্রদানের জন্য আবেদনপত্র প্রদান করেন। এর আগে ১২/১২/২০১২ ইং তারিখে বাংলাদেশ টেলিভিশনের মহাপরিচালক জনাব ম.হামিদ বরাবরে মন্ত্রী সুরঞ্জিত সেন গুপ্ত এবং মাননীয় সংসদ সদস্য এম.এ মান্নান মহোদয় এর যৌথ স্বাক্ষরিত মরণোত্তর গীতিকার হিসেবে তালিকাভুক্তির জন্য আবেদনপত্র প্রদান করা হয়।
এমতাবস্থায় বাংলাদেশের বর্তমান জনগণের সরকার, দুঃখী মানুষের আশার আলোর সরকার,উন্নয়নের সরকার যার কান্ডারী দেশনেত্রী গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশের সরকারের মাননীয় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। তাঁর প্রতি আমার আকুল আবেদন তিনি যেন বাংলার এই মহান সাধককে স্বীকৃতি দিয়ে প্রজন্মের পর প্রজন্ম তার ধারাকে অক্ষুন্ন রাখেন। এবং সুনামগঞ্জের পঞ্চরতœ বাউলের মধ্যমণি বাউল কামাল পাশার মরমী সংস্কৃতি কামালগীতিকে বাঁচিয়ে রাখেন।
লেখক : অধ্যাপক ডা. মো. উবায়দুল কবীর চৌধুরী,অধ্যক্ষ শমরিতা মেডিকেল কলেজ হাসপাতাল,পরিচালক কবির ন্যাশনাল স্কীন সেন্টার ও ২০২০ সালে চিকিৎসা ক্ষেত্রে স্বাধীনতা পুরস্কারপ্রাপ্ত চিকিৎসক,ঠিকানা বি৪,সেঞ্চুরী টাওয়ার,বড় মগবাজার,ঢাকা-১২১৭।
Leave a Reply