রত্নাগর্ভা ছাতক ও ছাতকের গুনিজন
রত্নাগর্ভা ছাতক ও ছাতকের গুনিজন
আনোয়ার হোসেন রনি
বাংলার লোক সাহিত্যের ও লোক সংস্কৃতির উৎস স্থান হলো ছায়া সুনিবিড় আমাদের এই পল্লী। পল্লীর জন মানুষ এককালে লোক কবিদের রচিত পুথি পাঠ, কবি গান, বাউল, মুর্শেদী, মারেফতি, শরিয়ত, পল্লীগীতি, দেশাত্ববোধক, আধুনিক, সারি, জারি, সহজিয়া লম্বায় কিচ্ছা, মালজোড়া ও পালাগান ইত্যাদি দ্বারা তাদের নিজস্ব কৃষ্টিতে ঐতিহ্য মন্ডিত করেছিলো। গ্রামের নিরব সকল গ্রামীণ কৃষক কাজের অবসরে রাতের পর রাত জেগে শুনতো লোকগাথা গীতিকা। কালের পরিবর্তে আজ আমাদের লোক সংস্কৃতির ঐতিহ্য বিস্মৃতির অঞ্চলে হারিয়ে যাচ্ছে। এর মাঝে আজও ধাপটের সাথে ঠিকে আছে আমাদের সুফি সাধনা ও বাউল সঙ্গীত। বৃহত্তর সিলেটের সুনামগঞ্জ জেলার লোক সাহিত্য ও লোক সংস্কৃতির “সুফি সাধক” পীঠস্থান হিসেবে নিজস্ব স্বকীয়তায় সমৃদ্ধ। ৩৬০ আউলিয়ার পবিত্র জন্ম ভূমি সিলেটকে বলা হয় আধ্যাত্মিক শহর ও সুফি সাধকের সাধনা ভূমি বলা হয় এখন ছাতকে এবং ছাতকে আধ্যাত্বিক সাধকের হিরার খনিন গোবিন্দগঞ্জ এলাকাকে বলা হয়। হাওর, বাওড়, প্রাকৃতিক সম্পদ অপূর্ব লিলা ভূমি বৃহত্তর সুনামগঞ্জ জেলা শিল্প নগর ছাতক উপজেলার অলি, আউলিয়া, দরবেশ, ফকির, সুফি সাধকের সাধনা ভূমি হিসেবে বাংলার লোক সাহিত্যে সুফি সাধনায় সংস্কৃতিক সম্মানের আসনে পৌছেঁ দিতে সক্ষম হয়েছেন। উর্দ্দু, ফার্সী, আরবী, নাগরি ভাষা ও ইংরেজী ভাষা দার্শনিকদের জন্মভূমি এই শহরে। শহরের আনাচে-কানাচে ছড়িয়ে পড়ে আছে পীর, দরবেশ, শাহদের, অসংখ্য কেরামতি এর সু-গভীর আধ্যাত্মিক জ্ঞানের ভান্ডার। এই শহরে জন্ম গ্রহণ করেছেন বুদ্ধিজীবি, ইসলামিক দার্শনিক, উপমহাদেশের উজ্জ্বল নক্ষত্র জাতীয় অধ্যাপক দার্শনিক দেওয়ান মোহাম্মদ আজরফ, বিদ্যা স্যার, মরমী কবি দর্বিন শাহ, আধ্যাত্বিকবীদ ফকির হিসেবে আফজল শাহ ওরফে আরমান আলী (রহঃ) কিংবদন্তীতুল্য সুফি ফকির, হযরত শাহ সুফি মোজাম্মিল আলী (রহঃ)। এদের মাঝে ছাতকে কৃতি সন্তান বৃহত্তর সিলেটের সুনামধন্য আধ্যাত্মিক মরমী কবি, দার্শনিক, লোকসাহিত্যে, সম্মানিত স্থান দখল করে রেখেছেন। আধ্যাত্মিক ফকির সাধক আফজল শাহ ওরফে আরামান আলী (রহঃ), মরমী কবি আসাদ উল্লাহ, উপমহাদেশের দার্শনিক দেওয়ান মোহাম্মদ আজরফ, হযরত শাহ সুফি আনাছ আলী (রহঃ), হযরত শাহ সূফি মোজাম্মিল আলী (রহঃ), মৌলানা আজিম শাহ (রহঃ) সুফি সাধক মাওলানা শাহ কাছিম আলী, সুফি সাধক শাহ ছাবাল আলী (রহঃ) জ্ঞানের সাগর মরমী কবি দুর্ব্বিন শাহ, ফকির হাসিম আলী, মরমী কবি মান উল্লাহ, মরমী কবি গিয়াস উদ্দিন আহমদ, মরমী কবি ক্বারী আমির উদ্দিন আহমদ, মরমী কবি মনির উদ্দিন নুরী, এস.এম শরীয়ত উদ্দিন এর জীবন ও কর্ম বিশেষ ভাবে উল্লেখযোগ্য। আফজল শাহ (রহঃ) হযরত সৈয়দ ইউসুফ ইরাকী (রহঃ) হযরত শাহজালাল এর ৩৬০ জন সঙ্গীর মধ্যে অন্যতম ছিলেন। তিনি ইরাকের হুসেনী সৈয়দ বংশে জন্ম গ্রহণ করেন। ইরাক থেকে হযরত শাহজালার (রহঃ) এর সঙ্গী হন বলে তাকে ইরাকী বলে ডাকা হতো। তিনি ছাতক উপজেলার সিংচাপইড় ইউনিয়নের সৈদেরগাঁও গ্রামে বসতি স্থাপন ও ধর্ম প্রচার করেন। তার নামানুসারে একটি ইউনিয়ন ও একটি গ্রামের নাম সৈদেরগাঁও নামকরন করা হয়, সেখানে তার মাজার অবস্থিত। হয়রত শাহ করিমাদাদ রুমি (রহঃ), এস.এম শরীয়ত আলী, পীর উসমান আলী শাহ, শাহ জমশেদ আলী পীর, শাহ ইয়াদ আলী, শাহ ইন্তাজ আলী, শাহ ফয়জন্দ আলী, শাহ বকশ আলী, মনাইশাহ, ফকির আব্দুল মানিক শাহ, নুর মামন শাহ হাফিজ, মিরশাহ (রহঃ), আরকান মুন্সী, গোলজারশাহ, মীরুশাহ, আয়াত শাহ, গেরা শাহ, নাজিম শাহ, মৌলা শাহ, নচিব আলী শাহ, আমান শাহ, ফয়াজ মুন্সী, শাহ, হেকিম শাহ, মামুন শাহ, হাসিম শাহ, মুলাই শাহ, আশু শাহ, খোদা বখসশাহ, জিকির শাহ, আব্দুল কাদির বকস শাহ, আজিম শাহ, পীর মাগাই শাহ, শাহ দিলমামন, হায়দার গাজী, আজিম শাহ, আব্দুল লতিফ, আব্দুল রশীদ পীর, ইদ্রিস ফকির, লাল শাহ, মধু শাহ, পাঁচপীর মাজার, গাজী মোকাম, মনছুর শাহ, আলী শাহ, জমির শাহ, টঙ্গী শাহ, আসাদ উল্লাহ, রমাই শাহ, জ্ঞানের সাগর মরমী কবি দুর্ব্বিন শাহ, বাংলাদেশ টেলিভিশন ও বেতার প্রথম শ্রেনীর গীতিকার সুরকার ছাতক প্রেসক্লাবের প্রতিষ্ঠাতা সভাপতি মরমী কবি গিয়াস উদ্দিন, মরমী কবি আজম আলী, হাসিম আলী শাহ, মনোহর আলী শাহ মুনু, মরমী কবি মাওলানা শাহ কাছিম আলী, ফকির মহব্বত উল্লাহ মতি শাহ, ফয়াজ মুন্সী, হায়দর শাহ, নইম শাহ, ফিরোজ শাহ, হবই শাহ, জরিপ শাহ, মরমী কবি আজমান আলী, মরমী কবি আসাদ উল্লাহ, মরমী কবি আজর আলী, মরমী কবি মরমী ক্বারী আমির উদ্দিন আহমদ, মরমী কবি জামাল উদ্দিন সুরুজ আলী, মরমী কবি, মরমী কবি আসকর আলী, মরমী কবি আব্দুল আজিজ চৌধূরী, কবি আব্দুল ওয়াহিদ, এস.এম শরীয়ত উল্লাহ, মরমী কবি মনির উদ্দিন নূরী, মরমী কবি সালা উদ্দিন ভান্ডারী, মরমী কবি হিজরত আহমদ, কবি রেনুফা বেগম রাখী, মরমী কবি আনোয়ার হোসেন রনি, মরমী কবি আলতাব আলী, মরমী কবি রমিজ শাহ, মরমী কবি হাসনাত মোহাম্মদ আনোয়ার, মরমী কবি শাহিনা জালালী পিয়ারা, কবি ফরিদ আহমদ, মরমী কবি হেলাল খান, কবি মনসুর আহমদ, কবি ক্বারী মামুন, কবি শফিকুল ইসলাম, কবি আবু হানিফা মোহাম্মদ, মোছাদ্দেক, কবি ক্বারী শরীফ আহমদ, কবি এস.এম. সাইফুল আলম সিদ্দিকী, কবি মোহাম্মদ ফজলুল হক, সালাহ উদ্দিন ভান্ডারী ছাতক, কবি মাসুম আহমদ লায়েক, কবি আবু বকর খোকন, কবি মাহবুবুর রহমান লায়েক, কবি সামছুন্নাহার, কবি আবুল খায়ের চৌধূরী বাচ্ছু, হাফিজ আলী আহমদ (রহঃ) নাগরি ভাষা পান্ডলিপি তৈরি করে রেখেছেন। আমাদের গ্রামীণ জনপদে বাউল সঙ্গীত এই সময় ব্যাপক আলোড়ন সৃষ্টি করেছিল। বৃহত্তর সিলেটের নাগরি ভাষায় ¯্রষ্টা সুফি সাধক, বাউল ভাবের সঙ্গীত জগতের, হযরত শাহ মোহাম্মদ আফজল শাহ (রহঃ), মরমী কবি দুর্বিনশাহ,মরমী কবি হাসিম আলী শাহ, মরমী কবি ক্বারী আমির উদ্দিন আহমদ, মরমী কবি গিয়াস উদ্দিন আহমদ আজীবন নিষ্ঠাবান ছিলেন ভাবের জগতে। তাদের জ্ঞানে হিরন্মত দীপ্তি ছড়িয়ে অস্তাচলে ডুবে গেলেও অসামান্য প্রতিভাধর আধ্যাত্মিক সাধক, সাধনা করে সৃষ্টি করে অসংখ্য শরিয়ত, মারিফত, হকিকত, সহ সকল সুফিবাদ, মুর্শেদী গান। সুরকার গীতিকার মরমী বাউল সাধক হিসেবে তাদের নাম চিরদিন শ্রদ্ধাবরে স্মরণযোগ্য। তাদের রচিত গান শুনে শ্রোতাদের মনে প্রশ্ন জাগে যে, কে সেই সঙ্গীতের ¯্রষ্টা? কি দারুণ সৃষ্টি অনাদিকাল ধরে ¯্রষ্টা সৃষ্টির ভেতরে এক অন্তহীন রহস্য লুকিয়ে রয়েছে। সেই প্রচ্ছন্ন রহস্য ভেদের অনুসদ্ধিৎসু সাধক, আফজল শাহ, দুর্ব্বিন শাহ, এর গান যেন হৃদয় তবিত। ¯্রষ্টা ঘিরে কখনো তারা বিগদ্ধ অন্তর বিদ্রোহে উর্চ্চকিত, কখনো ¯্রষ্টার প্রেমে আত্মহারা সান্নিধ্য কামনায় সমন্বিত পণ। আবার কখনো ¯্রষ্টার উদ্দেশ্য তারা জিজ্ঞাসা। আফজল শাহ, জ্ঞানের সাগর দুর্ব্বিন শাহ, মরমী কবি গিয়াস উদ্দিন আহমদ, সিলেটের সুুফি সাধক হিসেবে বহি বিশে^ সু-পরিচিত। তারা বেশী সংখ্যক গান তৈরি করেছেন মুর্শেদী শানে এবং তারা ফকির, দরবেশ, সাধু সন্নাসীর আখড়ায় তারা ব্যথিত হৃদয় খুজে পায় সুশীতল ছায়া। তখন থেকেই তাদের সঙ্গীত সাধনা শুরু করেছেন। কালক্রমে তারা ইসলামীক সুফি মতবাদের প্রতি অনুরক্ত হয়ে পড়েন। ইসলামী ভাব সাধনার পথে অগ্রসর হয়েছেন। সুফিবাদের ভিত্তিতে আধ্যাত্মিক সাধনায় তারা ¯্রষ্টার স্বরূপ উপলব্ধির চেষ্টা করেন। সঙ্গীত সাধনায় বিচিত্র স্তর এবং ধারা সম্পর্কে সম্যক জ্ঞান অর্জনের পিপাসা তাদের মুর্শেদী ও মারিফতি সঙ্গীতের অনুগামী করে তোলে। সুফিবাদ হলো ইসলামের মরমীত্রেই মরমী বানানটি অশুদ্ধ নয়। ভাষ্য যা বাংলাদেশে একটি বহুল পরিচিত ‘শব্দ’ শরিয়ত হল ইসলামের কর্মমুখী আচরণবাদী দিক। আর মারেফাত হল ইসলামের মর্মমুখী বা মরমী দিক। তবে সুফি মতবাদটি টিক মৌলিখ নয় তার মানে ইসলামের এই মরমী যার ফলে সুফিরা ইসলামী বিশ^াস থেকে সরে এসছেন বলে সুফিবাদের বিরুদ্ধে ইসলামী শান্ত্রবাদী গুলেমারা সংস্কার বিস্তার রোধ করা সম্ভব হয়নি। মতবাদটি দু’বার গতিতে প্রথমে পারস্যে-পরবর্তীকালে পারস্যে থেকে উত্তর ভারত এবং বাংলায় এসে পৌছে ঁছিল। কি ছিল সেই মরমী সুফিদের প্রাণ শক্তি উৎস ? এসব প্রশ্নে আজ ও আমরা বিস্মিত হই, পাশাপাশি বিচিত্র সুফি মতবাদের কারণে আজও সুফিবাদ নিয়ে আমাদের কৌতুহলের যেন কমতি নেই। কিন্তু সুফিবাদ নিয়ে বিতর্ক শেষ নেই। এসব সত্বেও বাংলার জন সমাজে প্রায় হাজার হাজার বছর ধরে মতবাদটি দারুন জনপ্রিয় ও গ্রহণীয়। বাংলার সুফি দরবেশদের চিন্তা ধারা আজ বাঙ্গালী মুসলমানের মনে গভীর প্রভাব বিস্তার করে আছে। প্রাথমিক যুগের সুফিদের অনুপ্রেরণা ছিল কোরআন শরীফ এর বিশেষ বিশেষ আয়াত। পরবর্তীকালে অবশ্য সেই আদি সুফিমত অনেকটা বিকৃত হয়ে পড়েছিল এবং সর্বশে^রবাদী ধ্যান ধারণার আচ্ছন্ন হয়ে পড়েছিল। পারস্যে, ভারত বর্ষে ও মধ্যযুগের বাংলার সু-প্রাচীনযুগ ও তন্ত্রের প্রভাবে সুফিবাদ ব্যাপক ভাবে পরিবর্তিত হয়ে যায়। এভাবে উদ্ভব ঘটেছিল “লৌকিক ইসলাম” এর মূলে রয়েছে বেদাত ও শিরক এর মতো ইসলাম বিরোধী ধ্যান ধারণা। প্রভাবিত করেছিল বাংলার বাউল দর্শনকে। পরিশেষে সুফিবাদ থেকে বাংলার উদ্ভব ঘটে পীবোদ বা ইসলামের আমূল বিকৃতি কোষ্ঠের থাকবে। কেননা গবেষকগণ এ বিষয় একমত নয়। কারও মতে ইসলামের প্রাথমিক যুগে যে সমস্ত দরিদ্র মুসল্লী মসজিদের প্রাঙ্গণে বসে নামাজীদের কাছ থেকে ভিক্ষা গ্রহণ করতেন তারাই সুফি। ফয়লসুফ এর মানে দার্শনিক। ফয়লসুফ শব্দ থেকে সুফি শব্দের উৎপত্তি। আরবি পন্ডিতদের মতে আরবি ‘ইসমু জামিদ’ শব্দ থেকে সুফি হল ইসলামের প্রাথমিক যুগ যে উদাসীন মানুষ পশমের জামা পড়ে সংসার থেকে নিলিপ্ত থাকবার চেষ্টা করতেন তারাই সুফি। ওরা জামা পরিধান করতেন। সাম্যবাদী খলিফা উমর (রাঃ) পরতেন লম্বা ঢোলা পশমী জোব্বা। আমরা জানি মহানবী হযরত মোহাম্মদ (সাঃ) ও চার খলিফার শাসন ব্যবস্থার অবসানের পর ইসলামী বিশে^ রাজতন্ত্রের উদ্ভব সঙ্গে।