১৯৭১: আগুনঝরা সেই দিনে খালেদা জিয়ার গ্রেফতার— দুই শিশুকে কোলে নিয়ে যুদ্ধের মধ্যবর্তী অনিশ্চয়তার পাঁচ সপ্তাহ
বিশেষ প্রতিবেদন
ঢাকা, ২ জুলাই ১৯৭১। স্বাধীনতার যুদ্ধের মাত্র তিন মাস পেরিয়েছে। চারদিকে মৃত্যুর হাহাকার, দখলদার পাকবাহিনীর নির্যাতন, খোঁজাখুঁজি, প্রতিশোধ আর আতঙ্কের ছায়া। ঠিক এমন ভয়াবহ সময়েই রাজধানীর সিদ্ধেশ্বরীর একটি সামান্য বাসায় সশস্ত্র হানাদারদের হাতে আটক হলেন দুই শিশুপুত্রসহ বেগম খালেদা জিয়া। যার স্বামী ততদিনে মুক্তিযুদ্ধের অন্যতম প্রধান সামরিক নেতা— মেজর জিয়াউর রহমান। তাঁর নেতৃত্বে গঠিত জেড-ফোর্স পূর্বাঞ্চলে পাকিস্তানি বাহিনীর বিরুদ্ধে প্রবল প্রতিরোধ গড়ে তুলেছে। তাই এই পরিবারের সন্ধানে তৎপরতা ছিল পাকিস্তানি বাহিনীর কাছে বিশেষ অগ্রাধিকার।
চট্টগ্রাম থেকে ঢাকায় স্বামীকে যুদ্ধের ময়দানে রেখে এক আকস্মিক যাত্রা ১৯৭১ সালের ১৬ মে। চট্টগ্রাম তখন রক্তাক্ত শহর। একদিকে মুক্তিযোদ্ধাদের প্রতিরোধ, অন্যদিকে পাকবাহিনীর গণহত্যা। শহরের বিভিন্ন পাড়া-মহল্লাদখলদারদের নিয়ন্ত্রণে, প্রতিটি ঘরবাড়ি আতঙ্কে স্থবির। ঠিক এই সময়ই দুই শিশু সন্তান—তখন মাত্র কয়েক বছরের তারেক রহমান ও কয়েক মাসের আরাফাত রহমান কোকোকে নিয়ে ঢাকায় আসার সিদ্ধান্ত নেন তাদের মা খালেদা জিয়া।
নদীপথে লঞ্চে যাত্রা। চারদিকে সেনাদের তল্লাশি, যাত্রীদের চোখেমুখে ভয়। কিন্তু যুদ্ধরত স্বামীর নিরাপত্তা ও পরিবারের টানাপোড়নের মধ্যেই এই ঝুঁকিপূর্ণ পথে উত্তর দিকে এগিয়ে চলে ছোট্ট পরিবারটি। সন্ধ্যার আগমুহূর্তে নারায়ণগঞ্জে পৌঁছালে সেখানে অপেক্ষা করছিলেন তাঁর বড় বোন প্রয়াত খুরশীদ জাহান হক এবং ভগ্নিপতি মোজাম্মেল হক। জিপ গাড়িতে করে তারা তিনজনকে নিয়ে আসেন ঢাকার খিলগাঁওয়ের বাসায়। কিন্তু যুদ্ধকালীন ঢাকায় তখন নিরাপদ জায়গা বলতে কিছুই নেই। গোয়েন্দা তৎপরতা, মুখোশধারী দালাল, রাজাকার-বদরের নির্দেশে সেনাবাহিনীর অভিযান—সবকিছু মিলিয়ে এই পরিবারটি যেন ছিল সবসময় টার্গেটে।
১০ দিনের মধ্যেই সংবাদ ছড়িয়ে পড়ে পাকিস্তানি গোয়েন্দাদের কাছে যুদ্ধের উত্তাপ ও অনিশ্চয়তার আবহে বাসায় আসার মাত্র ১০ দিনের মাথায় খবর চাউর হয়ে যায়—মেজর জিয়ার স্ত্রী ঢাকায় অবস্থান করছেন। মুক্তিযুদ্ধ পরিচালনায় জিয়াউর রহমানের ভূমিকা এবং তাঁর নেতৃত্বাধীন জেড-ফোর্সের শক্ত প্রতিরোধ পাকিস্তানি বাহিনীকে অতিষ্ঠ করে তুলেছিল। তাই তাঁর পরিবারের সন্ধানে অকাতরে শক্তি ব্যয় করতে তারা একটুও দ্বিধা করেনি। ২৬ মে ভগ্নিপতি মোজাম্মেল হক জানতে পারলেন, পাকবাহিনী খিলগাঁওয়ের ওই বাসার অবস্থান সম্পর্কে অবহিত। গোয়েন্দা ও রাজাকারদের নজরদারি শুরু হয়ে গেছে। যে কোনো সময় অভিযান চালানো হতে পারে। এর পর থেকে শুরু হলো আত্মগোপনের দীর্ঘ, কষ্টকর ও অনিশ্চিত দিন। এক আত্মীয়ের বাসা থেকে আরেকজনের বাসা—কোথাও স্থায়ী আশ্রয় মেলে না।
কেউ আতঙ্কে দরজা খুলতে চায় না। কেউ আবার নিজের পরিবারকে বাঁচাতে অপারগতা জানায়। একদিকে ছোট দুই সন্তানকে নিয়ে পালিয়ে বেড়াচ্ছেন এক নারী; অন্যদিকে স্বামীকে যুদ্ধের ময়দানে জীবন-মৃত্যুর লড়াইয়ের সংবাদ প্রতিনিয়ত শুনছেন দূর থেকে। ভয়, উদ্বেগ, অনিশ্চয়তা—সবকিছু মিলিয়ে তখন তাঁর প্রতিটি দিন ছিল এক ভয়ংকর মানসিক যুদ্ধ। ৩ জুন: আবারও স্থানান্তর—অজানা ঠিকানায় রাত কাটানো পরিস্থিতি আরও সঙ্কটময় হয়ে উঠল জুনের শুরুতেই। মোজাম্মেল হক বাধ্য হলেন খালেদা জিয়া ও তাঁর সন্তানদের অন্যত্র স্থানান্তর করতে। ৩ জুন তারা চলে যান অজানা এক ঠিকানায়—যেখানে তারা কয়েকদিন লুকিয়ে থাকেন। এরপর সেখান থেকেও সরিয়ে নিয়ে যাওয়া হয় তাঁদের, কারণ আশঙ্কা ছিল ওই বাড়ির অবস্থানও হয়তো জেনে ফেলেছে পাকিস্তানি সেনারা। যুদ্ধকালীন ঢাকা ছিল এক বিশাল কারাগার। ঘর থেকে বের হওয়া, রাস্তা দিয়ে যাওয়া—সবই ছিল ঝুঁকিপূর্ণ। এমন পরিবেশে আরেকবার আত্মগোপনের স্থান খুঁজে পাওয়া ছিল কঠিনতম কাজ। অবশেষে ভূতত্ত্ব জরিপ অধিদফতরের ডেপুটি ডিরেক্টর এস কে আবদুল্লাহ শরণাপন্ন হলেন। তিনি নিজের সিদ্ধেশ্বরীর বাসায় আশ্রয় দিলেন খালেদা জিয়াকে। এ বাড়িতেই শুরু হয় অপেক্ষার দিন—স্বামীর খবর, যুদ্ধের খবর, চারদিকে ছড়িয়ে থাকা ভয়াবহ ঘটনার খবর। কিন্তু সবার অগোচরে ক্রমেই কাছে চলে আসছিল হানাদার বাহিনীর তল্লাশি দল। ঢাকার লুকিয়ে থাকা সেই নারী— যে ছিলেন পাকিস্তানিদের চোখে একজন গুরুত্বপূর্ণ বন্দি খালেদা জিয়া তখন কেবল একজন রাজনৈতিক নেত্রীর স্ত্রী নন—তিনি যুদ্ধরত একজন সামরিক নেতার পরিবার। জিয়াউর রহমানের নেতৃত্বাধীন জেড-ফোর্স এ সময় উত্তর-পূর্বাঞ্চলে তুমুল আঘাত হানছে পাকিস্তানি বাহিনীর ওপর। তাই তাঁর পরিবারের উদ্দেশে পাকিস্তানি সেনাদের তৎপরতা ছিল প্রতিশোধমূলক। জেড-ফোর্সের প্রতিটি অভিযান ছিল তাদের চোখে আঘাত, ক্ষত, পরাজয়ের প্রতিচ্ছবি। তাই জিয়াউর রহমানকে চাপে রাখতে বা তাঁকে দমন করতে পাকিস্তানি সরকারি বাহিনী তাঁর পরিবারকে ব্যবহার করতে চেয়েছিল—এটা অনেক গবেষকই পরে উল্লেখ করেছেন। এদিকে ঢাকায় প্রতিদিন বাড়তে থাকে আটক, নিখোঁজ, হত্যার ঘটনা। বাংলার ঘরে ঘরে তখন ভয়—কখন কাকে তুলে নিয়ে যাওয়া হয়! এমন এক সময়ের ভেতর দিয়ে দুই শিশুকে নিয়ে বেঁচে থাকার লড়াই করছিলেন খালেদা জিয়া। সিদ্ধেশ্বরীর বাড়িতে শেষ কয়েক সপ্তাহ—এক ছায়াযুদ্ধের গল্প জুনের শেষ সপ্তাহ। সিদ্ধেশ্বরীর বাসাটিতে তখন প্রবল উত্তেজনা।
রাস্তার মোড়ে মোড়ে সেনাদের টহল। হঠাৎ, মাঝেমধ্যে গুলির শব্দ। অন্য বাড়িতে তল্লাশি। এস কে আবদুল্লাহর পরিবার খালেদা জিয়ার নিরাপত্তা নিয়ে উদ্বিগ্ন হচ্ছিলেন প্রতিদিন। ঘরের ভেতর আলো জ্বালানোর ক্ষেত্রেও সতর্কতা। দরজার কড়া নড়লেই বিভীষিকার ছায়া নেমে আসে ঘরে। তবুও, শিশুদের খাওয়ানো, ঘুম পাড়ানো, সান্ত্বনা দেওয়া—সব দায়িত্বই সামলাচ্ছিলেন খালেদা জিয়া। তাঁর মনে সবসময় তাড়া ছিল—যুদ্ধরত স্বামীর অবস্থা কী? বেঁচে আছেন তো?
অনিশ্চয়তার সেই দিনগুলো যেন বাঙালির মুক্তিযুদ্ধের একটি অজানা অধ্যায়ের অংশ। ২ জুলাই ভোর: পাকিস্তানি হানাদার বাহিনীর আকস্মিক অভিযান অবশেষে সেই ভয়ানক দিন এসে গেল। ২ জুলাই ১৯৭১, শুক্রবার ভোর। ঢাকার আকাশ সবে ফর্সা হচ্ছে। ঠিক সেই সময় সিদ্ধেশ্বরীর বাড়ির সামনে থামে একটি সামরিক যান। সশস্ত্র পাকিস্তানি সৈন্যরা ঘেরাও করে ফেলে পুরো বাড়িটি। মুহূর্তেই শুরু হয় তল্লাশি ও শোরগোল।
পরিস্থিতি বোঝার আগেই সৈন্যরা ঘরে ঢুকে পড়ে।
একজন অফিসার জিজ্ঞেস করেন— “Where is Khaleda Zia?”এরপরই আটক করা হয় তাঁকে, তাঁর দুই শিশুপুত্রকে এবং বাড়ির সবাইকে। বলা হয়, তাদের “প্রশ্ন করার জন্য” সেনানিবাসে নিয়ে যাওয়া হবে। কিন্তু যুদ্ধকালীন পাকিস্তানি বাহিনীর আচরণ জানত সবাই—এই কথার পেছনে লুকিয়ে থাকে ভয়াবহ প্রতিশোধ। ধরা পড়ার পরই প্রকাশ পেল—পাকিস্তানি গোয়েন্দারা তাঁর অবস্থান সম্পর্কে বহু আগেই খবর পেয়েছিল। সময় নিয়েছিল শুধু সঠিক মুহূর্তটির অপেক্ষায়।
একটি পরিবারের গ্রেফতার—একটি দেশের স্বাধীনতাযুদ্ধের সাক্ষ্য বেগম জিয়ার গ্রেফতার যেন প্রতীকীভাবে অনেক কিছুই দেখিয়ে দেয়। এটাই প্রমাণ, পাকিস্তানি বাহিনী বুঝেছিল—
স্বাধীনতার প্রশ্নে মেজর জিয়া ও তাঁর সৈন্যরা কত বড় হুমকি। সেই হুমকির মোকাবিলায় তারা ভয় দেখাতে চেয়েছিল এক যোদ্ধার পরিবারকে। কিন্তু ইতিহাস বলে—এ ধরনের ভয় দেখানো কখনো মুক্তির সংগ্রাম থামাতে পারেনি। পাকিস্তানি বাহিনীর হাতে পরিবারের এই গ্রেফতার মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাসে এক বেদনাময় অধ্যায় হয়ে আছে আজও।
গ্রেফতারের পর কী হয়েছিল? বিভিন্ন সূত্র জানায়—
হেফাজতে নেওয়ার পর বেগম জিয়া ও তাঁর দুই সন্তানকে কয়েকদিন জিজ্ঞাসাবাদ ও নজরদারিতে রাখা হয়।
তবে আন্তর্জাতিক চাপ, স্থানীয় প্রতিক্রিয়া এবং সামরিক কর্তাদের অভ্যন্তরীণ দ্বিধার কারণে পরে তাঁদের মুক্তি দেওয়া হয়। কিন্তু সেই কয়েক সপ্তাহ—যা ছিল বন্দিদশা, ভয়, নির্যাতনের আশঙ্কা—একজন মা এবং দুই শিশু সন্তানকে জীবনের গভীরতম দুঃসহ অভিজ্ঞতার মধ্যে ফেলে দিয়েছিল।
যুদ্ধ শেষ—কিন্তু সেই দিনের স্মৃতি আজও ইতিহাসের অংশ
১৯৭১ সালে মুক্তিযুদ্ধের চূড়ান্ত বিজয়ে নতুন স্বাধীন বাংলাদেশ আত্মপ্রকাশ করে। মেজর জিয়া যুদ্ধজয়ের পর ফিরে আসেন দেশের স্বাধীনতার পতাকা হাতে। কিন্তু তাঁর পরিবারের যে দুঃসহ যাত্রাপথ—সেটি অনেকটাই ইতিহাসের আড়ালে লুকিয়ে আছে।
সেই ১৬ মের যাত্রা, ২ জুলাইয়ের গ্রেফতার, আরো বিপজ্জনক আত্মগোপনের দীর্ঘ ৪৫ দিন—সবকিছু মিলিয়ে এটি যেন মুক্তিযুদ্ধের এক অজানা অধ্যায়। একজন নারী, দুই শিশু, চারপাশে দখলদার বাহিনীর ভয়াবহতা— তারপরও বেঁচে থাকা, প্রতিরোধ করা এবং স্বাধীনতার স্বপ্নকে বুকে লালন করা—এই গল্প বাঙালির সংগ্রামী যাত্রার অবিচ্ছেদ্য অংশ।
শেষকথা স্বাধীনতার যুদ্ধে অস্ত্র হাতে লড়াই করা বীরদের নাম ইতিহাসে সোনালী অক্ষরে লেখা থাকে।কিন্তু বন্দিদশা, নিগ্রহ ও অনিশ্চয়তার মধ্যেও যারা পরিবার নিয়ে বেঁচে ছিলেন—
তাদের গল্পও সমান গুরুত্বপূর্ণ। ২ জুলাই ১৯৭১ সালে খালেদা জিয়ার গ্রেফতার শুধু একটি রাজনৈতিক পরিবারের ঘটনা নয়—এটি পাকিস্তানি শাসনের নিষ্ঠুরতা, বাঙালির আত্মত্যাগ এবং স্বাধীনতার মূল্য কতটা কঠিন ছিল— তার এক নীরব প্রমাণ।
Leave a Reply