মরমী বাউল চাঁন মিয়া:সাধনা,
গান ও বাউলতত্ত্বের আলো !
#কবি ও সাংবাদিক আনোয়ার হোসেন রনি #
বাংলার লোকসংস্কৃতির বিস্তীর্ণ আকাশে যাঁরা নীরবে অথচ গভীর আলো ছড়িয়ে গেছেন, মরমী বাউল চাঁন মিয়া (চান মিয়া) তাঁদেরই একজন। সাধনা, গান ও মানবতাবাদের মেলবন্ধনে গড়ে ওঠা তাঁর জীবন ছিল সত্য ও সুন্দরের নিরবচ্ছিন্ন আরাধনা। সুললিত কণ্ঠের আবেগ-মাধুর্যে মণ্ডিত তাঁর গান শ্রোতাদের ভাবালুতার অনন্য প্রভাবে বিমুগ্ধ করত। আধ্যাত্মিকতার পথে গানকে যিনি করেছিলেন আত্মার বাহন—সেই বাউল চাঁন মিয়া আজও বাংলার বাউলতত্ত্বে এক অনিবার্য নাম।
লোকসংস্কৃতির একনিষ্ঠ সাধক বাঙালির লোকসংস্কৃতির একনিষ্ঠ সাধক ও ঐতিহ্যের নির্ভীক ধারক–বাহক ছিলেন মরমী বাউল শিল্পী চাঁন মিয়া। সিলেটের মরমী আকাশে তিনি ছিলেন এক উজ্জ্বল নক্ষত্র—যাঁর আলো আজও নিভে যায়নি।
বাউল ও বাউলার কালের একজন আদর্শ শিল্পী, গীতিকার ও খ্যাতিমান সুরস্রষ্টা হিসেবে তিনি মননশীল পাঠক ও সংবেদনশীল শ্রোতাদের হৃদয়ে গড়ে তুলেছিলেন এক স্বতন্ত্র ভূবন। সাধনার মানসপুত্র রূপে তিনি শুধু গান গাইতেন না—গান হয়ে উঠতেন, সুরে সুরে আত্মসমর্পণের নিদর্শন স্থাপন করতেন।
শৈশব, সংগ্রাম ও গানের আশ্রয় চাঁন মিয়ার শৈশব ছিল দুঃখ–সংগ্রামে মোড়ানো। অল্প বয়সেই পিতৃহীন হয়ে পড়েন তিনি। জীবিকার তাগিদে কখনো গরু চরানো, কখনো গৃহস্থের কাজ—এইসবের মধ্যেই কাটে তাঁর দিন। কিন্তু শ্রমের ফাঁকে ফাঁকে গান ছিল তাঁর আশ্রয়। মাঠের আল, নদীর পাড়, গ্রামের হাট—সবখানেই তিনি গাইতেন। সেই গানে ছিলজীবনের ক্ষুধা, বেদনা আর মুক্তির আকুতি। এই সময়েই তাঁর কণ্ঠে ধরা পড়ে এক স্বতঃস্ফূর্ত মরমী সুর, যা ধীরে ধীরে তাঁকে বাউল পথের দিকে টেনে নেয়।
গুরুবাদী সাধনা ও বাউলপথ লোকমুখে প্রচলিত আছে—চাঁন মিয়া জ্ঞানের সাগর ফকির দুর্বিন শাহের শিষ্য ছিলেন; যদিও কখনো কখনো এই তথ্য বাউল খোয়াজ মিয়ার সঙ্গে মিশে যায়। তবু এটা নিশ্চিত যে, তিনি গুরুবাদী সাধনায় বিশ্বাসী ছিলেন। বাউল সাধনায় গুরু হলেন পথপ্রদর্শক—যাঁর কাছে দেহতত্ত্বের গূঢ় রহস্য উন্মোচিত হয়। চাঁন মিয়ার সাধনায় ছিল নিয়মিত সুরসাধনা, সংযম, মানবপ্রেম ও অহংবর্জন। তিনি বলতেন—“গান শুধু শোনাবার জন্য নয়, গান নিজেকে চেনার পথ।”
বাউলতত্ত্ব: ভেতরের মানুষকে খোঁজা বাউলতত্ত্ব মূলত মানুষের ভেতরের মানুষকে খোঁজার দর্শন। জাত–ধর্ম–বর্ণের ঊর্ধ্বে উঠে মানবাত্মার মুক্তিই বাউল সাধনার লক্ষ্য। চাঁন মিয়ার গানে এই দর্শনের সুস্পষ্ট প্রতিফলন দেখা যায়। দেহকে তিনি দেখেছেন সাধনার ক্ষেত্র হিসেবে—যেখানে শ্বাস–প্রশ্বাস, প্রেম, সংযম আর চেতনার মিলনে জন্ম নেয় আত্মজ্ঞান। তাঁর গানে দেহতত্ত্বের পাশাপাশি ছিল প্রেমতত্ত্ব—যেখানে প্রিয়তম মানেই সর্বসত্তা।
গান, সুর ও কণ্ঠের মাধুর্য চাঁন মিয়ার গান ছিল বাউল, মরমী ও আধ্যাত্মিক ধারার সমন্বয়। দেশাত্মবোধক অনুভবও তাঁর কিছু গানেঅনুরণিত হয়েছে। অধিকাংশ গান তিনি নিজেই লিখেছেন ও সুর করেছেন। তাঁর কণ্ঠে ছিল গভীরতা, আবেগ ও স্বচ্ছতা—যা শ্রোতার হৃদয়ে সরাসরি আঘাত করত। সহজ ভাষায় গভীর কথা বলাই ছিল তাঁর গানের বৈশিষ্ট্য। গানে তিনি প্রশ্ন তুলতেন—আমি কে? কোথা থেকে এলাম? কোথায় যাব?
গ্রাম থেকে মঞ্চ—সর্বত্র সমান জনপ্রিয়তা গ্রামের আসর থেকে শুরু করে বিভিন্ন লোকসংগীতের মঞ্চে চাঁন মিয়ার গান শুনে শ্রোতারা আবিষ্ট হয়ে পড়তেন। তাঁর গানের আবেগ–মাধুর্য শ্রোতাকে ভাবালুতার ভেতর নিয়ে যেত। অনেকে বলতেন—চাঁন মিয়ার গান শোনা মানে নিজেকে শোনা। তাঁর কণ্ঠে এমন এক আকর্ষণ ছিল, যা বয়স–শ্রেণি নির্বিশেষে সবাইকে টানত।
‘কলের গান’ থেকে টেপের যুগ বিশেষ করে ‘কলের গান’ (গ্রামোফোন) থেকে টেপ রেকর্ডারের যুগে তাঁর গানের জনপ্রিয়তা ছিল শীর্ষে।তৎকালীন সময়ে এই অঞ্চলে চাঁন মিয়ার গান ছাড়া টেপ রেকর্ডার কল্পনা করা ছিল প্রায় অসম্ভব। তাঁর সুললিত কণ্ঠ, আবেগমাখা মাধুর্য ও ভাবালুতার অনন্য প্রভাবে শ্রোতারা মন্ত্রমুগ্ধ হয়ে থাকতেন। আজও অনেক ভক্তের কাছে তাঁর গানের ক্যাসেট অতি আদরে সংরক্ষিত আছে।
আল্লাহপ্রেম ও আধ্যাত্মিকতা মহান রাব্বুল আলামিনের ওপর ছিল তাঁর অগাধ বিশ্বাস। আল্লাহপ্রেমের ভাবুকতায় যখন তিনি সুর ধরতেন—শ্রোতারা পিন পতন নীরবতায় ডুবে যেতেন। স্রষ্টার কাছে সৃষ্টি যেন একাকার হয়ে যেত আত্মসমর্পণের বিনয়াবনত চিত্তে। সুরের ঝংকারে ভাবসাগরে ঢেউ উঠত—অপূর্ব করুণ নাটকীয়তায়।
বহুল সমাদৃত গানসমূহ তাঁর বহুল সমাদৃত গানগুলোর মধ্যে উল্লেখযোগ্য“আমি অধম পাথকী, জোড় হস্তে তোমায় ডাকি, কর সুখি দেখাইয়া দিদার“সাহারাতে ফুটলরে ফুল, দুজাহানের বাদশা মকবুল, ভ্রমর আকুল গন্ধ পাইয়া তার”“ক্ষণস্থায়ী এ জগতে রবে না কেউ চিরকাল, আশা যাওয়া বিফল হইল, পারের কড়ি নাই আমার“সব খোয়াইলাম কামিনীর হাতে, একদিন ধরিবে জমদুতে“কে কয় পিরীত ভালা গো, এর মত নাই জ্বালা”এই গানগুলো শুধু বিনোদন ছিল না—ছিল আত্মজিজ্ঞাসা, জীবনবোধ ও আত্মসমর্পণের অনুপম দলিল।
জীবনদর্শন ও চরিত্র অর্থের মোহ কিংবা আভিজাত্যের লোভ তাঁকে স্পর্শ করতে পারেনি। আদর্শিক চরিত্রের অধিকারী এই শিল্পী ছিলেন সরল জীবনযাপনে বিশ্বাসী। জীবনের পথে বহু বিপত্তি এলেও তিনি নিরবে ত্যাগ–তিতিক্ষা ও অসীম ধৈর্যের সঙ্গে মোকাবিলা করেছেন। পরিষ্কার–পরিচ্ছন্নতা ও পরিপাট্য ছিল তাঁর নিত্যসঙ্গী। শুভ্র পোশাক পরিধান করতেন নিয়মিত। তাঁর বিশ্বাস ছিল—শুভ্রতা বাহ্যিক নয়, এটি মননের লক্ষণ; পরিচ্ছন্ন মনেই সৃষ্টির আলো জ্বলে।
উত্তরাধিকার ও প্রজন্মান্তর বাউল চাঁন মিয়ার জীবনের একটি গুরুত্বপূর্ণ দিক হলো বাউল ঐতিহ্যের উত্তরাধিকার। তাঁর পুত্র মিজানুর রহমান মিজান একজন বাউল সাধক হিসেবে ব্যাপক পরিচিতি লাভ করেছেন সিলেটে। পিতার দেখানো পথে তিনি সাধনা ও গানের ধারাকে এগিয়ে নিয়ে যান। এর মধ্য দিয়ে প্রজন্ম থেকে প্রজন্মে বাউল সাধনার ধারাবাহিকতা বজায় থাকে—যা বাংলার লোকসংস্কৃতির জন্য অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ।
গবেষণা ও গ্রন্থ চাঁন মিয়ার জীবন ও গান নিয়ে গবেষণামূলক কাজ হয়েছে। তাঁর গান সংকলিত হয়েছে বিভিন্ন সংগ্রহে। উল্লেখযোগ্য গ্রন্থের মধ্যে আছে—“বাউল চাঁন মিয়ার জীবন ও গান”। এসব গ্রন্থ বাউল গবেষকদের জন্য মূল্যবান সম্পদ, যেখানে তাঁর দর্শন ও সৃষ্টির বিস্তৃত পরিচয় পাওয়া যায়।
চিরস্মরণীয় অবদান মরহুম বাউল চাঁন মিয়া আজ আমাদের মাঝে নেই, কিন্তু তাঁর গান আছে—যা সময় পেরিয়ে কথা বলে। বাউলতত্ত্বের ধারায় তাঁর অবদান চিরস্মরণীয় লোকসংস্কৃতির এই সাধক দেখিয়ে গেছেন—মানুষের ভেতরের মানুষকে খুঁজে পাওয়াই জীবনের আসল সাধনা। সিলেটের প্রান্তিক গ্রাম থেকে উঠে এসে তিনি হয়ে উঠেছিলেন বাংলার বাউল আকাশের এক উজ্জ্বল নক্ষত্র। তাঁর সুললিত কণ্ঠ, মরমী গান ও মানবতাবাদী দর্শন আজও মানুষকে আলো দেখায়—সত্যের, সুন্দরের এবং আত্মসমর্পণের পথে।!#
Leave a Reply