পাথরের পৃথিবীতে কাঁচের হৃদয়
—এক অনুভূতিহীন সময়ের ভাঙা মানুষের গল্প
কবি ও সাংবাদিকআনোয়ার হোসেন রনি
এই পৃথিবী দিনদিন পাথরের মতো কঠিন হয়ে উঠছে। চারপাশে যেন শুধু অদৃশ্য শীতলতা, হিসাব-নিকাশ আর অপরিসীম ব্যস্ততা। এর মাঝেই বাঁচতে হয় মানুষকে—রক্ত-মাংসের, অনুভূতির, স্বপ্নভরা মানুষকে। সেই মানুষের হৃদয়টি বড় বেশি কাঁচের মতো। একটু আঘাতেই চূর্ণ হয়ে যায়, সামান্য স্পর্শেই ফেটে ওঠে অদৃশ্য ফাঁটল। অথচ ক্ষয়ে যেতে যেতে, ভেঙে যেতে যেতে সে নিজেকে লুকিয়ে রাখে অন্তরালের দেয়ালে। কেউ টেরই পায় না ভিতর থেকে কী প্রবল যন্ত্রণা তাকে ছিন্নভিন্ন করে দিচ্ছে।
অন্তর্জগতের এই নীরব কান্না বহুদিন ধরেই সমাজের প্রান্তে প্রান্তে ছড়িয়ে আছে। মানুষ চাইলেও প্রকাশ করতে পারে না তার ভাঙনের কথা। অনেকের কাছে জীবনের কঠিনতা—অন্যদের অনুভূতির প্রতি উদাসীনতা—আজ যেন সাধারণ নিয়মে পরিণত হয়েছে। আর সেখানেই শুরু হয় এক গভীর মানবিক সংকট, যেখানে মানুষের কোমল হৃদয় হারায় তার নিরাপদ আশ্রয়, ভেঙে পড়ে অচেনা অচলতার পাহাড়ের তলায়।
কাঁচের হৃদয়ের গল্প।একজন মানুষের হৃদয় হয়তো দেখলে শক্ত মনে হয়। সে হাসে, কাজ করে, দায়িত্ব পালন করে। কিন্তু ভিতরে ভিতরে তার হৃদয়টা গড়া হয় তুলো-সাদা কোমলতায়—ফুরফুরে, নরম, ভালোবাসায় ভরা। তুচ্ছ কারও কথায়, অনিচ্ছাকৃত কোনো আচরণে বা অপ্রত্যাশিতভাবে পাওয়া অপমান-অবহেলায় সেই কোমল হৃদয়টি কখনও কখনও ভেঙে যায়। কাঁচের মতোই—পরিষ্কার, স্বচ্ছ, কিন্তু ভঙ্গুর।
কাঁচ ভাঙলে যেমনাংশু-টুকরো আর আগের মতো এক করতে গেলে হাজারবার কাটে হাত, মানুষের ভাঙা হৃদয়ের পুনর্গঠনও তেমনই কঠিন। কেউ দেখে না তার তীক্ষ্ণ ব্যথা, কেউ উপলব্ধিও করে না সেই ক্ষয়মান দিনগুলো। বাইরে থেকে উজ্জ্বল, ভেতরে ক্ষয়ের সুঁচো ভয়ংকরভাবে বেয়ে যায় জীবনবিন্দু।।যে সমাজ অনুভূতিকে ভুলে গেছে।আজকের পৃথিবী যেন খুব কমই সময় নেয় কাউকে বুঝতে। শুনতে চায় না কারো নিঃশব্দ কান্না। মানুষের ভাঙনকে অনেকে দুর্বলতা ভাবে, কেউ কেউ আবার নিছক মজা। সমাজে তাই যারা ভেতরে ভেঙে যায়—তারা আরও বেশি নিঃসঙ্গ হয়ে পড়ে।
জীবনের চারপাশে নির্মমতার অদৃশ্য দেয়াল। কেউ একটু থেমে তাকায় না। নিজের লড়াই, নিজের সফলতা, নিজের উদ্বেগ—এসবের ভিড়ে হারিয়ে যায় অসংখ্য ভাঙা হৃদয়ের আর্তনাদ। অথচ কাঁচের হৃদয়ের মানুষরাই সবচেয়ে বেশি রঙ দেয় এই পৃথিবীতে। তাদের হাসি পৃথিবীর আলো বাড়ায়, তাদের দুঃখের গভীরতা কর্মের শক্তি হয়ে ওঠে। কিন্তু তারা ভাঙলে সমাজের আলোও নিভে যায়।
ভাঙার পরও টিকে থাকার লড়াই কাঁচ ভাঙলে যেমন ক্ষয়ে যায়, মানুষের হৃদয়ও ঠিক সেভাবেই ক্ষয়ে ক্ষয়ে একসময়ে নিঃশেষ হতে থাকে। থেমে থেমে জ্বলে ওঠা তুষের উনুনের মতো—বেদনাগুলো দৃশ্যমান না হলেও ভেতরে ভয়ংকর আগুন জ্বলে। অনেকে দিন শেষে আবার উঠে দাঁড়ায়, হাসে, চলাফেরা করে; তবুও তার অন্তরে থাকে ছাই হয়ে যাওয়া ক্ষতচিহ্ন।
বিশেষজ্ঞদের মতে, বর্তমান ব্যস্ত জীবনের চাপ, মানুষের প্রতি মানুষের উদাসীনতা, সম্পর্কের অনিশ্চয়তা এবং সহানুভূতির অভাব—এই সবই মিলিয়ে বাড়িয়ে তুলছে মানসিক ভাঙনের হার। মানুষ ভাঙছে, কিন্তু বলতে পারছে না। কাঁচ ভাঙলে শব্দ হয়, হৃদয় ভাঙলে হয় নীরবতা—আর সেই নীরবতাই সবচেয়ে ভয়ংকর।
যাদের ভাঙন কেউ দেখে না ফিচারের কাজ শুধু গল্প বলাই নয়; এখানে সত্যিটাও প্রকাশ পায়। প্রতিদিনই আমাদের আশপাশে কেউ না কেউ ভেঙে যাচ্ছে। হয়তো সে কর্মস্থলের সহকর্মী, হয়তো বিশ্ববিদ্যালয়ের বন্ধু, হয়তো ঘরের কাছের মানুষ। তাদের হাসির আড়ালে থাকে অসংখ্য অপ্রকাশিত ব্যথা। তারা কেঁদে ওঠার আগেই নিজেদের থামিয়ে নেয়। কারণ সমাজ তাদের শেখায়—কান্না দুর্বলতা, ব্যথা প্রকাশ অপরিপক্বতা। এই ভুল ধারণাই মানুষকে আরও গভীর অন্ধকারে ঠেলে দেয়। ভেঙে যাওয়া কাঁচ যেমন নিজেকে জুড়তে পারে না, ভাঙা হৃদয়ও একা তা পারে না—প্রয়োজন হয় ভালোবাসা, বোঝাপড়া, যত্ন, এবং সবচেয়ে বেশি—একটু মানবিকতা।
এই কাহিনি সবার এই ফিচার শুধু একজন ভাঙা মানুষের গল্প নয়—এটা আমাদের সময়ের প্রতিচ্ছবি। আমরা ভুলে যাচ্ছি, মানবিকতার ছোঁয়া ছাড়া পৃথিবী আরও কঠিন হয়ে উঠবে। ভাঙা কাঁচের মতো ভেঙে যাবে সম্পর্ক, সমাজ, বিশ্বাস। আর কাঁচের হৃদয়ের মানুষগুলো যদি বারবার অবহেলায় ভেঙে যায়, তাহলে এই পাথরের পৃথিবী একদিন সত্যিই দমবন্ধ অচেনা মরুভূমিতে পরিণত হবে।
অল্প আঘাতে ভেঙে যাওয়া কাঁচের হৃদয় হয়তো কখনও আগের মতো হয়ে উঠবে না। তাতে ফাঁটল থাকবে, ক্ষয় থাকবে। কিন্তু সেই হৃদয় তার যন্ত্রণা নিয়েই আবার ওঠে দাঁড়ায়, বাঁচতে শেখে। কারণ জীবনের শক্তি ব্যথা ভুলে না গিয়ে—ব্যথা নিয়েই সামনে এগোনোর মধ্যে।।পাথরের পৃথিবী যতই অমানবিক হোক, একেকটি কাঁচের হৃদয়ই এই বিশ্বের আলো। তাই ভাঙা হৃদয়কে অবহেলা নয়, প্রাপ্য সম্মান, ভালোবাসা আর অনুভূতির স্বীকৃতি দেওয়া—আজ সময়ের সবচেয়ে জরুরি প্রয়োজন।
Leave a Reply