নূরুল কবীরের ওপর মব হামলা
মতপ্রকাশের স্বাধীনতার সংকট ও রাষ্ট্রীয় ব্যর্থতার নগ্ন প্রকাশ
ঢাকা: বাংলাদেশের সাংবাদিকতা ও বুদ্ধিবৃত্তিক অঙ্গনে নূরুল কবীর একটি সুপ্রতিষ্ঠিত নাম। দীর্ঘ কয়েক দশক ধরে ক্ষমতার অপব্যবহার, রাষ্ট্রীয় দমন-পীড়ন, গণতন্ত্র ও মতপ্রকাশের স্বাধীনতা নিয়ে নির্ভীকভাবে কথা বলা এই প্রবীণ সাংবাদিক ও চিন্তকের ওপর সম্প্রতি সংঘটিত মব হামলার ঘটনা দেশজুড়ে গভীর উদ্বেগ ও প্রতিক্রিয়ার জন্ম দিয়েছে। সংশ্লিষ্টরা বলছেন, এটি কেবল একজন ব্যক্তির ওপর হামলা নয়; বরং মতপ্রকাশের স্বাধীনতা, সাংবাদিকতার নিরাপত্তা এবং রাষ্ট্রের আইনশৃঙ্খলা রক্ষার সক্ষমতার ওপর একটি গুরুতর প্রশ্নচিহ্ন।
ঘটনাটি এমন এক সময়ে ঘটল, যখন দেশ ইতোমধ্যে রাজনৈতিক অস্থিরতা, সহিংসতা ও সহনশীলতার ঘাটতিতে ভুগছে। বিশ্লেষকদের মতে, নূরুল কবীরের ওপর হামলা বাংলাদেশের ক্রমবর্ধমান ‘মব সংস্কৃতি’র একটি উদ্বেগজনক প্রতিফলন, যা ভবিষ্যতের জন্য অশনি সংকেত।
দীর্ঘ পথচলার সাহসী কণ্ঠ নূরুল কবীর কোনো নির্দিষ্ট সময় বা শাসনামলের সাংবাদিক নন—এমনটাই বলছেন তাঁর সহকর্মী ও সমসাময়িকরা। তিনি দীর্ঘদিন ধরে রাষ্ট্রক্ষমতায় যারাই ছিল, তাদের অন্যায় ও অসংগতির বিরুদ্ধে কলম ধরেছেন। ক্ষমতাসীনদের অসন্তোষ, হুমকি কিংবা সামাজিক চাপ—এসবকে উপেক্ষা করেই তিনি লিখেছেন এবং কথা বলেছেন।
একাধিক সাংবাদিক নেতা মনে করেন, তাঁকে কেবল সাম্প্রতিক রাজনৈতিক প্রেক্ষাপটে মূল্যায়ন করা হলে তাঁর দীর্ঘ সংগ্রামী জীবনের প্রতি অবিচার করা হবে। নূরুল কবীর সব সময়ই ভিন্নমতকে যুক্তি ও নীতির জায়গা থেকে তুলে ধরেছেন। এ কারণেই তিনি বারবার আক্রমণের লক্ষ্য হয়েছেন—এবার তা রূপ নিয়েছে প্রকাশ্য শারীরিক লাঞ্ছনায়। ঘটনার পটভূমি.প্রথম আলো ও ডেইলি স্টার কার্যালয়ের সামনে সাম্প্রতিক সহিংসতার প্রেক্ষাপটে ঘটনাস্থলে উপস্থিত হয়েছিলেন নূরুল কবীর। পেশাগত দায়িত্ব ও নৈতিক অবস্থান থেকেই তিনি সেখানে যান—এমনটাই জানিয়েছেন তাঁর ঘনিষ্ঠজনেরা। একজন দায়িত্বশীল সাংবাদিক হিসেবে পরিস্থিতি পর্যবেক্ষণ, তথ্য সংগ্রহ এবং বাস্তবতা অনুধাবন করা তাঁর কাছে অস্বাভাবিক কিছু ছিল না। কিন্তু পরিস্থিতি দ্রুত নিয়ন্ত্রণের বাইরে চলে যায়। প্রত্যক্ষদর্শীদের ভাষ্য অনুযায়ী, উত্তেজিত একটি দল তাঁকে ঘিরে ধরে এবং শারীরিকভাবে লাঞ্ছিত করে। প্রবীণ এই সাংবাদিকের ওপর এমন আচরণে উপস্থিত অনেকেই হতবাক হয়ে যান। সাংবাদিক মহলের প্রশ্ন—যদি নূরুল কবীরের মতো পরিচিত ও সম্মানিত একজন ব্যক্তি নিরাপদ না হন, তবে মাঠপর্যায়ের সাংবাদিকদের নিরাপত্তা কোথায়?
মব সংস্কৃতির ভয়াবহ বিস্তার সাম্প্রতিক বছরগুলোতে দেশে মব হামলার ঘটনা উদ্বেগজনক হারে বেড়েছে। সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে উসকানি, গুজব ও বিভ্রান্তিকর তথ্য ছড়িয়ে পড়ার মাধ্যমে দ্রুত সংঘবদ্ধ হয়ে সহিংসতায় জড়িয়ে পড়ছে একশ্রেণির মানুষ। আইন বিশেষজ্ঞরা বলছেন, মব কখনোই ন্যায়বিচারের বিকল্প হতে পারে না।.ইতিহাস বিশ্লেষণে দেখা যায়, মব মানেই যুক্তির পরাজয় এবং মানবিকতার অবক্ষয়। মবের হাতে বিচার তুলে দিলে সমাজে ন্যায় প্রতিষ্ঠিত হয় না; বরং বিশৃঙ্খলা ও ভয় ছড়িয়ে পড়ে। নূরুল কবীরের ওপর হামলার ঘটনাও সেই বাস্তবতাকেই সামনে এনেছে।
রাষ্ট্র ও প্রশাসনের ভূমিকা প্রশ্নবিদ্ধ.এই ঘটনার পর সবচেয়ে বেশি যে প্রশ্নটি উঠেছে, তা হলো—রাষ্ট্র কোথায় ছিল? আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর ভূমিকা কেন কার্যকর ছিল না? কেন বারবার মব সহিংসতা ঘটলেও দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি নিশ্চিত করা যাচ্ছে না? বিশ্লেষকদের মতে, শুধু নিন্দা বা বিবৃতি দিয়ে রাষ্ট্রের দায়িত্ব শেষ হয় না। মাঠপর্যায়ে দৃশ্যমান উপস্থিতি, দ্রুত ব্যবস্থা গ্রহণ এবং অপরাধীদের আইনের আওতায় আনা—এসবই রাষ্ট্রের মৌলিক কর্তব্য। নূরুল কবীরের ওপর হামলা সেই ব্যর্থতার একটি স্পষ্ট উদাহরণ।
ওসমান হাদির মৃত্যু ও রাজনৈতিক প্রেক্ষাপট এই ঘটনার প্রেক্ষাপটে আলোচনায় এসেছে ওসমান হাদির মৃত্যুর ঘটনাও। কোনো মৃত্যুই কাম্য নয়—এ বিষয়ে সবাই একমত। তবে রাজনৈতিক বিশ্লেষকরা বলছেন, এই মৃত্যু পুরোপুরি রাজনৈতিক প্রেক্ষাপট থেকে বিচ্ছিন্ন নয়। উসকানি, উদ্দেশ্যপ্রণোদিত বক্তব্য ও সংঘাতমূলক রাজনীতির ফলেই পরিস্থিতি জটিল হয়েছে।এ প্রশ্নও উঠেছে—একটি মৃত্যুকে কেন্দ্র করে কেন প্রথম আলো, ডেইলি স্টার বা ছায়ানটের মতো প্রতিষ্ঠানে হামলা ও ভাঙচুর হবে? সংশ্লিষ্টদের মতে, এটি মূলত যুক্তির বদলে শক্তি প্রদর্শনের প্রবণতার বহিঃপ্রকাশ।
প্রতিষ্ঠান নয়, আঘাত বিবেকের ওপর প্রথম আলো, ডেইলি স্টার কিংবা ছায়ানট—এসব প্রতিষ্ঠান কেবল ইট-পাথরের ভবন নয়। এগুলো জ্ঞান, সংস্কৃতি ও বিবেকচর্চার প্রতীক। এসব প্রতিষ্ঠানে হামলা মানে মুক্ত চিন্তা ও মতপ্রকাশের ওপর আঘাত।বুদ্ধিজীবীরা বলছেন, যুক্তি ও বুদ্ধিবৃত্তিক বিতর্কের জায়গায় সহিংসতা বেছে নেওয়া দুর্বলতারই প্রমাণ। যারা যুক্তিতে পরাজিত হয়, তারাই সহিংসতার আশ্রয় নেয়।
ভবিষ্যৎ নিয়ে শঙ্কা.নূরুল কবীরের ওপর হামলা একটি বড় প্রশ্ন সামনে এনেছে—বাংলাদেশ কি ধীরে ধীরে ভিন্নমতের প্রতি অসহিষ্ণু হয়ে উঠছে? মতপ্রকাশকে কি শত্রুতা হিসেবে দেখা হচ্ছে? যদি এই প্রবণতা চলতে থাকে, তবে গণতান্ত্রিক রাষ্ট্র হিসেবে বাংলাদেশের ভবিষ্যৎ নিয়ে শঙ্কা থেকেই যায়।
সাংবাদিক সংগঠনগুলো মনে করছে, আজ নূরুল কবীর আক্রান্ত হয়েছেন, আগামীকাল অন্য কেউ। এই ধারাবাহিকতা থামাতে না পারলে ভিন্নমত আরও সংকুচিত হবে।
কী করা প্রয়োজন বিশ্লেষকদের মতে, এখনই স্পষ্ট অবস্থান নেওয়া জরুরি।— মব সহিংসতার বিরুদ্ধে জিরো টলারেন্স নীতি গ্রহণ— সাংবাদিক ও মতপ্রকাশকারীদের নিরাপত্তা নিশ্চিত করা
— দ্রুত ও দৃষ্টান্তমূলক বিচার — সহনশীলতা ও যুক্তিনির্ভর রাজনৈতিক সংস্কৃতি গড়ে তোলা নূরুল কবীরের ওপর হামলা আমাদের সমাজের গভীর সংকটের প্রতিচ্ছবি। এই দেশ যেন মবের দেশে পরিণত না হয়—এটাই এখন সবচেয়ে বড় চ্যালেঞ্জ। রাষ্ট্র যদি ন্যায়, বিবেক ও সাহসকে নীতির কেন্দ্রবিন্দুতে না আনে, তবে ক্ষতিগ্রস্ত হবে পুরো সমাজ।
ভবিষ্যৎ প্রজন্ম যেন বলতে পারে—এক সময় সংকট এসেছিল, কিন্তু আমরা যুক্তির পথ ছাড়িনি। নূরুল কবীরদের মতো মানুষরা তখনও সত্যের পাশে দাঁড়িয়েছিলেন, আর রাষ্ট্রও তাঁদের পাশে দাঁড়াতে শিখেছিল।
Leave a Reply