কালারুকী হুজুর (রাহ.)
সিলেটের এক আলোক–
অক্ষয় পুরুষের জীবনকথা
(১৯৩৪–২০০৬)
কবি ও সাংবাদিক আনোয়ার হোসেন রনি #
সুনামগঞ্জের শিল্পনগরী ছাতকের পূর্ব–উত্তর প্রান্তে শান্ত–নিবিড় একটি আলোকিত গ্রাম হচ্ছে কালারুকা। পল্লির সরলতা, সুরমা নদী–নালা আর সবুজ প্রকৃতির আবহে এখানেই জন্ম নিয়েছিলেন একজন মানুষ, যিনি আজও এলাকার ধর্ম–শিক্ষা, সংস্কৃতি ও সাহিত্যচর্চার চেতনাকে জাগ্রত রেখেছেন।
তিনি ছিলেন শায়িরে আলা মাওলানা মুহাম্মাদ রাঈসুদ্দীন কালারুকী (রাহিমাহুল্লাহ)। যিনি যেমন একজন দ্বীনদার আলেম, তেমনই ছিলেন একজন ব্যতিক্রমধর্মী বহু প্রতিভা কবি, ঝরঝরে বক্তা, সফল মাদ্রাসা প্রতিষ্ঠাতা ও হাজারো মানুষের নিকট শ্রদ্ধেয় উপদেশদাতা।
তার জীবন শুধু একটি ব্যক্তিগত জীবনের গল্প নয়; বরং পুরো উত্তর সিলেটের ধর্মীয়–সাংস্কৃতিক ইতিহাসের একটি গুরুত্বপূর্ণ অধ্যায়। জন্ম থেকে ইনতিকাল পর্যন্ত জীবন পথ বিশ্লেষণ করলে শিক্ষায়, সমাজসেবায়, আধ্যাত্মিক সাধনায় ও কাব্যচর্চায় এক অনন্য উচ্চতার পরিচয় পাওয়া যায়।
কালারুকার মাটির গন্ধে যার শৈশব, হাসনাবাদের আঙিনায় যার শিক্ষার প্রথম আলো, গাছবাড়ির ঐতিহ্যে যার মনন পেয়েছে জ্ঞান–জ্যোতি—সেই মানুষটি আজও উত্তর সিলেটের বাতাসে উচ্চারিত হন এক বিশেষ নামে—শায়িরে আলা।
শুধু আলেম নন, শুধু শিক্ষক নন, শুধু প্রতিষ্ঠাতা নন—তিনি ছিলেন এক বহুমাত্রিক আলো, এক স্বতন্ত্র সাংস্কৃতিক ধারা, এক কাব্য জাগানিয়া হৃদয়। সিলেটের মাদ্রাসা অঙ্গনে এমন শুদ্ধ ছন্দ, তাৎক্ষণিক কবিতা আর গভীর আধ্যাত্মিকতার সংমিশ্রণ আর খুব কমই দেখা গেছে। মাদ্রাসা–মসজিদের মঞ্চে থেকে শের–বাহা, ফার্সী কাব্যের ছন্দে ডুবে থাকা ছাত্র জীবন থেকে শুরু করে গ্রামীণ সমাজের নৈতিক অন্ধকার ভেদ করা উপদেশ–নসীহত—সব মিলিয়ে তিনি ছিলেন এক বিরল কীর্তিমান।তাঁর সেই জীবনকথারই নির্যাস—রচনার তীক্ষ্ণ ভাষায়, অথচ তাঁর স্বভাব সুলভ নম্রতার আবরণ ছুঁয়ে।
তার জন্ম: ছাতকের নিভৃত গ্রামে আলো নামার দিন ১৯৩৪ খ্রিস্টাব্দ। সুনামগঞ্জের ছাতক থানার কালারুকা গ্রামের এক শান্ত, সাধারণ পরিবার। পিতা মরহুম রহমতুল্লাহ—ধার্মিক, সৎ, চরিত্রবান মানুষ। ছয় ভাই ও তিন বোনের মাঝখানে তৃতীয় সন্তান হিসেবে রাঈসুদ্দীনের জন্ম যেন পরিবারে এক নতুন বৈচিত্র্যের ইশারা নিয়ে আসে।
তার নিজ গ্রামের প্রাথমিক বিদ্যালয়ে তাঁর পড়াশোনার হাতে খড়ি। সময়টা ব্রিটিশ শাসনের শেষ–দিক। গ্রামীণ বাংলায় শিক্ষার অবকাঠামো তখনো সীমিত। কিন্তু ছোট্ট রাঈসুদ্দীনের চোখে তখন থেকেই লক্ষ্যের দীপ্তি—পড়বে, জানবে, মানুষ হবে।
১৯৪৬ সালে তিনি ভর্তি হন স্থানীয় হাসনাবাদ দারুল হাদীস মাদ্রাসায়, সিলেট অঞ্চলের একটি ঐতিহ্যবাহী প্রতিষ্ঠান (প্রতিষ্ঠা ১৯২৯)। এখানে তাঁর শিক্ষা জীবনের দ্বিতীয় অধ্যায়। তাঁর শিক্ষকদের মধ্যে ছিলেন তাঁরই গ্রামের আলেম, মরহুম মৌলবী আর্শদ আলী (রাহ.)—যিনি রাঈসুদ্দীনের হৃদয়ে আলেমি চেতনার দৃঢ় ভিত্তি স্থাপন করেন।
গাছ বাড়ি মাদ্রাসা: যেখানে মননে যুক্ত হলো উচ্চশিক্ষার আলো ১৯৫০ সাল। উচ্চশিক্ষার তীব্র আকাঙ্ক্ষা তাঁকে ছাতক ছাড়িয়ে নিয়ে যায় কানাইঘাট থানার সর্ব প্রাচীন ও খ্যাতিমান প্রতিষ্ঠান গাছবাড়ি জামীউল উলুম কামিল মাদ্রাসায় (প্রতিষ্ঠা ১৯০১)। এখানে তিনি ১৯৫৪ সালে আলিম, ১৯৫৬ সালে ফাযিল, এবং ১৯৫৮ সালে কামিল পরীক্ষা শেষ করেন। কিন্তু সনদ–সার্টিফিকেটই তাঁর শিক্ষার চূড়ান্ত ছিল না। প্রকৃত অর্জন ছিল—জ্ঞান, চরিত্র, শিল্পবোধ ও আধ্যাত্মিকতার সমন্বয়। এই সময়েই তিনি সিলেটের অন্যতম আলোক প্রজ্বলিত ব্যক্তিত্ব আল্লামা ফুলতলী ছাহেব কিবলাহ (রাহ.)–এর স্নেহ সান্নিধ্যে প্রবেশ করেন। পরবর্তীতে তিনি তাঁর তরীকতের ইজাযতপ্রাপ্ত খলীফা হন। এখানেই জন্ম নেয় তাঁর অন্তরের আরেক পরিচয়—কবি রাঈসুদ্দীন, যিনি পরবর্তী সময়ে হয়ে ওঠেন শায়িরে আলা। শিক্ষকতা থেকে ইমামতি—জীবনের কর্মপথের প্রথম অধ্যায় ছাত্রজীবন শেষে শিক্ষা–জগতে তাঁর প্রত্যাবর্তন ছিল দ্রুত ও স্বাভাবিক।
১৯৫৮–১৯৫৯: হাসনাবাদ মাদ্রাসায় অধ্যাপনা
১৯৬০: বিশ্বনাথ দারুল উলুম আলিয়া মাদ্রাসা
১৯৬১–১৯৬৩: দিরাই থানার জামলাবাজ জামে মসজিদের ইমামতি মানুষকে শিক্ষা দেওয়া, সততার পথে ফিরিয়ে আনা, ধর্মীয় অনুশাসন শেখানো—এসবই তাঁর নেশা। তাঁর কণ্ঠ, তাঁর কাব্য, তাঁর উপদেশ—সবকিছুতে ছিল এক স্বতন্ত্র আকর্ষণ।
মাদ্রাসা প্রতিষ্ঠা: স্বপ্ন ও সাহসের এক গল্প ১৯৬৭ সাল। তার নিজ গ্রামের মানুষকে আলোর পথে আনার জন্য, স্বীয় মুর্শিদ ফুলতলী ছাহেব কিবলার প্রতি শ্রদ্ধার নিদর্শন হিসেবে তিনি প্রতিষ্ঠা করেন—
কালারুখা লতিফিয়া ইসলামিয়া মাদ্রাসা। প্রথমে এটি ছিল কালারুকা পয়েন্টের পশ্চিমে (বর্তমান নোয়াব আলী জামে মসজিদের পশ্চিমে)। পরে প্রাকৃতিক দুর্যোগে পুরনো ভবন ধ্বংস হলে তিনি তার নিজ উদ্যোগে জমি কিনে মাদ্রাসাটি বর্তমান স্থানে স্থানান্তর করেন। তিনি প্রায় ৩০ বছর হেড মৌলানা/প্রধান শিক্ষক হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন। এ মাদ্রাসা ২০০৭ সালে প্রথম দাখিল পরীক্ষার অনুমতি পায়। ২০১৯ সালে এমপিওভুক্ত হয়। বর্তমানে (২০২৫ সাল) আলিম স্তরে নিয়মিত পাঠদান চলছে—যা তাঁর স্বপ্নের পূর্ণতা। আজকের লতিফিয়া মাদ্রাসার প্রতিটি ইট যেন তাঁর হাতের পরিশ্রম, তাঁর দুঃখ–সুখ, তাঁর অশ্রু ও প্রার্থনার সাক্ষ্য বহন করে। শায়িরে আলা: যেভাবে জন্ম নিলো এক উপাধি কাব্যচর্চা তাঁর ছিল রক্তে। ছাত্রজীবনে তিনি পড়েছিলেন—ফার্সী ভাষার গুলেস্তাঁ, বোস্তাঁ, পাঁন্দেনামা প্রাক–ইসলামী আরব কবিতার সাবআ মুআল্লাক্কা কাহিনী–ভিত্তিক রচনা জুলেখা, করীমা এবং মোট প্রায় ১০০০–র মতো স্তবক তাঁর মুখস্থ ছিল।
তিনি যখন শের–বাহা বা গজল–সভায় অংশ নিতেন, দর্শক–শ্রোতারা নিস্তব্ধ হয়ে যেতেন। কারণ সেখানে বই থেকে শে’র পড়ে শোনানো চলে না—প্রতিপক্ষকে জবাব দিতে হয় তাৎক্ষণিক সৃষ্ট শের দিয়ে। এবং তিনি ছিলেন সেই জবাবের অনন্য দক্ষ শায়ির। শায়িরে আলা উপাধির পেছনের কিংবদন্তি ঘটনা বিখ্যাত আলেম–কবি আল্লামা হরমুজ উল্লাহ শয়দা ছাব (রাহ.) ছিলেন তাঁর প্রবল ভক্ত। একদিন মাহফিল থেকে ফেরার পথে তিনি রাঈসুদ্দীন ছাহেবকে বলেন—“কালারুকী! আমরা এতক্ষণ ধইরা বসলাম, একটা শে’রও বানাইতে পারলাম না। তুমি পারবা? আলো–অন্ধকারে দাঁড়িয়েই কালারুকী ছাহেব বললেন—“ইলাহী আতা কর রহমত মুছলছল,বমজলিছে শয়দায়ে আমরতল। শয়দা ছাহ মুগ্ধ হয়ে বলেছিলেন—“আজ থেকে আপনি শায়িরে আলা।” সিলেট বিভাগে এ উপাধি যার একক অধিকারে—তিনি–ই সেই মানুষ। মুর্শিদের শানে তাঁর শে’র: অগাধ প্রেমের প্রমাণ ১৯৮৫ সালে দারুল ক্বিরাত মজিদিয়া ফুলতলী ট্রাস্টের মুখপত্রে প্রকাশিত হয়েছিল তাঁর শে’রগুলোর কিছু অংশ—“ইলাহী, জোড় হস্তে মাংগি দুআ আমরা সব বেকলি,উজালা রাখিও সদায় ঝাঙায়ে ফুলতলী ইলাহী।আরো—“ইলাহী, তোমারও দরগাহে করি উঠাইয়া দুই হাত,দরাজ করিও জনাব ফুলতলীর হায়াত ইলাহী। সত্যিই দেখা গেছে—কালারুকী ছাহেব ২০০৬ সালে ২৫ ডিসেম্বর ইন্তেকাল করেন, ফুলতলী ছাহেব কিবলা ইনতিকাল করেন ২০০৮ সালে—অর্থাৎ তাঁর দোয়ায় মুর্শিদের জীবন ছিল আরও দীর্ঘ।
জলসায় তাৎক্ষণিক শে’র – দর্শকের হৃদয় জয়
তিনি যে স্থানে যেতেন, সে স্থানকে কেন্দ্র করে তাৎক্ষণিক কাব্য রচনা করতেন।নিজ গ্রামের নাম নিয়ে বিখ্যাত শে’র—“ইলাহী, এহছান করিও জারী দূর করিও সুস্তি,উজালা রাখিও সদায় কালারুকার বস্তি ইলাহী। শ্রোতাদের বলতেন—“সবে কও আমীন, আমীন।”মুহুর্মুহু ‘আমীন’–এর ঢেউয়ে ভেসে যেত আসর। সুবক্তা ও প্রবাদ–স্রষ্টা কালারুকী ছাহেব উপদেশ দেওয়ার তাঁর নিজস্ব ধরন ছিল—তীক্ষ্ণ, ছন্দময় এবং গ্রামীণ বাস্তবতানির্ভর।
তাঁর কিছু বিখ্যাত প্রবাদ—১. দশে বেরলে রাজা, আর বাখলে বেরলে গাছ। ২. মাইনষে ছিনে মানুষ, আর উলোশে ছিনে খেঁথা।৩. পরার মন্দ নিত নিত, নিজর মন্দ অচমপিত। ৪. এক মন ইলমর লগে, দশ মন আখল লাগে। ৫. বল ভালা আপনার বল, ছায়া ভালা বিরকর তল। এসব কেবল প্রবাদ নয়—সমাজ–বাস্তবতার তীক্ষ্ণ বিশ্লেষণ। উপদেশমূলক বাণী—নীতির অমোঘ শিক্ষা মানুষকে সতর্ক করতেন সহজ–সরল ভাষায়—“নিজে ঠগা খাইলিও, কিন্তু পরারে ঠইগগো না।”“যতোকান করবায়, অতোকান পাইবায়।“খবরদার, কোনো দিন উস্তাদর লগে বিয়াদ্দবি কইরো না।”“ভাল মাইনষর পাও ধইলিও—কমিন–কমজারার মুখ ধইও না।”তাঁর উপদেশে ছিল অভিজ্ঞতার তাপ, বাস্তবতার দৃঢ়তা, ও নৈতিকতার দীপ্ততা। কাবা শরীফ যিয়ারত: আত্মার প্রথম সফর ১৯৬৩ সালে একজন প্রিয় ব্যক্তির বদলি হজ পালনের লক্ষ্যে তিনি জাহাজযোগে মক্কায় গমন করেন। তখনকার দিনে হজ ছিল কঠিন, দীর্ঘ, ব্যয়বহুল—তবুও তিনি সাহস করলেন। এই যিয়ারত তাঁর অন্তর্মনে নতুন দরজা খুলে দেয়—তাঁর পরবর্তী জীবন হয়ে ওঠে অধিক সংযত, অধিক জ্ঞানে দীপ্ত, অধিক আধ্যাত্মিক। পরিবার–পরিচয়: রেখে যাওয়া উত্তরাধিকার ইন্তেকালের সময় তিনি রেখে যান—
স্ত্রী (যিনি ২০২২ সালে তাঁর কবরের পূর্বে দাফন হন) ২ পুত্র,৬ কন্যা,এবং দেশ–বিদেশের অসংখ্য ভক্ত, মুরিদ, ছাত্র, শুভাকাঙ্ক্ষী ১ম পুত্র মাওলানা মুহাম্মাদ জালালুদ্দীন প্রবাসে—২য় পুত্র হাফিয মুহাম্মাদ কুতবুদ্দীন দেশে—কন্যাদের মধ্যে তিনজন প্রবাসে, তিনজন দেশে—সকলেই সপরিবারে স্বচ্ছল ও শিক্ষিত। তার ইন্তেকাল: আলোর প্রদীপ নিভে গেল, কিন্তু উজ্জ্বলতা রয়ে গেল চিরকাল আজ ২৫ ডিসেম্বর ২০০৬,সিলেটের রাগিব আলী মেডিকেল। সেদিন সন্ধ্যার দিকে নিভে যায় এক আলোকপুরুষের দীপ শিখা। পরদিন জানাযায় ইমামতি করেন তাঁর ভাগিনা—মাওলানা আব্দুল হাই ছাতকী, সৎপুর কামিল মাদ্রাসার সাবেক প্রিন্সিপাল। গ্রামবাসী, ছাত্র, আলেম–উলামা, ভক্ত—সবার চোখে জল। কারণ কালারুকা হারালো এক মহামূল্যবান সন্তান;সিলেট হারালো তার এক অসামান্য শায়ির;মাদ্রাসা–জগৎ হারালো এক নির্মল আলেম।—তিনি ছিলেন আলোর মানুষ, জীবনের কবি, সমাজের শিক্ষক মাওলানা মুহাম্মাদ রাঈসুদ্দীন কালারুকী ছাহেব (রাহ.)–এর জীবন ছিল এক পূর্ণাঙ্গ আলোক–বৃত্ত। যার মাঝে— জ্ঞানের দীপ্তি, কবির সংবেদন, আলেমের আধ্যাত্মিকতা,শিক্ষকের মমত্ব, সমাজ–নেতার দায়িত্ববোধ, আর মানুষের প্রতি গভীর ভালোবাসা তিনি চলে গেছেন, কিন্তু রেখে গেছেন—একটি মাদ্রাসা, একটি প্রজন্ম, অসংখ্য শে’র, উপদেশ, প্রবাদ, স্মৃতি—আর একটি অনন্য উপাধি—“শায়িরে আলা” যা আজও সিলেটের বাতাসে উচ্চারিত হয় শ্রদ্ধায়, ভালোবাসায়, বিস্ময়ে।
Leave a Reply