কথাসাহিত্যিক রাবেয়া খাতুন আর নেই
ছাতক প্রতিনিধি,
কথাসাহিত্যিক রাবেয়া খাতুন আর নেই। রাজধানীর বনানীর নিজ বাসায় রোববার বিকাল ৫টায় তিনি বার্ধক্যজনিত কারণে ইন্তেকাল করেন (ইন্নালিল্লাহি … রাজিউন)। স্বাধীনতা পুরস্কার, একুশে পদক ও বাংলা একাডেমিসহ অসংখ্য পুরস্কার ও সম্মাননায় ভূষিত প্রখ্যাত এই কথাসাহিত্যিকের বয়স হয়েছিল ৮৬ বছর। তিনি দুই ছেলে, দুই ছেলের বউ, দুই মেয়ে ও দুই জামাতাসহ নাতি-নাতনি রেখে গেছেন।
সর্ব সাধারণের শ্রদ্ধা জানানোর জন্য আজ দুপুর ১২টা থেকে দুপুর ১টা পর্যন্ত বাংলা একাডেমি প্রাঙ্গণে রাবেয়া খাতুনের লাশ রাখা হবে। দুপুর ২টায় চ্যানেল আই প্রাঙ্গণে জানাজা শেষে তার লাশ বনানী কবরস্থানে দাফন করা হবে। বিশিষ্ট শিশুসাহিত্যিক ও টেলিভিশন ব্যক্তিত্ব এবং ইমপ্রেস টেলিফিল্ম লি., চ্যানেল আই-এর ব্যবস্থাপনা পরিচালক ফরিদুর রেজা সাগরের মা রাবেয়া খাতুনের মৃত্যুতে শিল্প-সাহিত্য অঙ্গনে শোকের ছায়া নেমে এসেছে।এক সময়ের জনপ্রিয় টেলিভিশন উপস্থাপক স্থপতি ফরহাদুর রেজা প্রবাল তার ছোট ছেলে। তিনি বর্তমানে অস্ট্রেলিয়া প্রবাসী। বড় জামাতা মুকিত মজুমদার বাবু টেলিভিশন উপস্থাপক, প্রকৃতি ও জীবন ফাউন্ডেশনের চেয়ারম্যান এবং চ্যানেল আই ও ইমপ্রেস গ্রুপের পরিচালক। ছোট জামাতা জহির উদ্দিন মাহমুদ মামুন বিশিষ্ট শিল্পপতি, চ্যানেল আই ও ইমপ্রেস গ্রুপের পরিচালক। বড় পুত্রবধূ কনা রেজা বিশিষ্ট নারী উদ্যোক্তা ও পান-সুপারির স্বত্বাধিকারী। ছোট মেয়ে ফারহানা কাকলী গৃহিণী। কীর্তিমান এ সাহিত্যিকের মৃত্যুতে শোক প্রকাশ করেছেন রাষ্ট্রপতি মো. আবদুল হামিদ ও প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। আরও শোক জানিয়েছেন তথ্যমন্ত্রী ড. হাছান মাহমুদ, এলজিআরডি প্রতিমন্ত্রী স্বপন ভট্টাচার্য, পানি সম্পদ প্রতিমন্ত্রী কর্নেল (অব.) জাহিদ ফারুক ও পানি সম্পদ উপমন্ত্রী একেএম এনামুল হক। চ্যানেল আই পরিবারও গভীরভাবে শোকাহত। রাবেয়া খাতুন সাহিত্যের সব শাখায় সফলভাবে বিচরণ করেছেন। দীর্ঘ জীবনে তিনি বাংলা সাহিত্যকে যেমন সমৃদ্ধ করেছেন তেমনি ভূষিত হয়েছেন অসংখ্য পুরস্কারেও। বাংলা সাহিত্যের উজ্জ্বল নক্ষত্র রাবেয়া খাতুন ১৯৩৫ সালে বিক্রমপুরে জন্মগ্রহণ করেন। লেখালেখির পাশাপাশি শিক্ষকতা এবং সাংবাদিকতাও করেছেন। উপন্যাস, ছোটগল্প, ভ্রমণ কাহিনী, কিশোর উপন্যাস, স্মৃতিকথাসহ চলচ্চিত্র ও নাট্যজগতেও বেশ বিচরণ ছিল রাবেয়া খাতুনের।তার মুক্তিযুদ্ধভিত্তিক উপন্যাস ‘মেঘের পরে মেঘ’ অবলম্বনে একই নামে নির্মিত হয়েছিল চলচ্চিত্র। তার উপন্যাস অবলম্বনে নির্মিত ‘মধুমতি’ এবং ‘কখনো মেঘ কখনো বৃষ্টি’ও প্রশংসিত হয়েছে সব মহলে।তার স্বামী প্রয়াত এটিএম ফজলুল হক ছিলেন দেশের চলচ্চিত্রবিষয়ক প্রথম পত্রিকা ‘সিনেমা’র সম্পাদক ও চিত্রপরিচালক। বাংলাদেশের প্রথম শিশুতোষ চলচ্চিত্র ‘প্রেসিডেন্ট’-এর পরিচালকও তিনি।কথাসাহিত্যিক হিসেবে সমধিক পরিচিত হলেও রাবেয়া খাতুন শিক্ষকতা ছাড়াও দীর্ঘদিন যুক্ত ছিলেন সাংবাদিকতার সঙ্গেও। ইত্তেফাক, সিনেমা পত্রিকা ছাড়াও তার নিজস্ব সম্পাদনায় পঞ্চাশের দশকে বের হতো ‘অঙ্গনা’ নামের একটি মহিলা মাসিক পত্রিকা। তার প্রকাশিত পুস্তকের সংখ্যা একশরও বেশি। এর মধ্যে রয়েছে উপন্যাস, গবেষণাধর্মী রচনা, ছোটগল্প, ধর্মীয় কাহিনি, ভ্রমণকাহিনি, কিশোর উপন্যাস, স্মৃতিকথা প্রভৃতি। রেডিও, টিভিতে প্রচারিত হয়েছে তার অসংখ্য নাটক, জীবন্তিকা ও সিরিজ নাটক।রাবেয়া খাতুন লেখা উপন্যাসের সংখ্যা পঞ্চাশটিরও বেশি, এ পর্যন্ত চার খণ্ডে সংকলিত ছোটগল্প সংখ্যায় চারশরও বেশি। ছোটদের জন্য লেখা গল্প-উপন্যাস সংখ্যায় কম নয়। রাবেয়া খাতুন বাংলাদেশের ভ্রমণসাহিত্যের অন্যতম লেখক। কর্মজীবনে অনেক মানুষের সান্নিধ্যে এসেছেন তিনি। ছোটগল্প দিয়ে শুরু হলেও লেখকপরিচয়ে প্রথমত তিনি ঔপন্যাসিক। প্রথম উপন্যাস ‘মধুমতী’ (১৯৬৩) প্রকাশের সঙ্গে সঙ্গেই শক্তিমান কথাসাহিত্যিক হিসাবে পরিচিতি পান।ক্ষয়িষ্ণু তাঁতি সম্প্রদায়ের জীবনসংকট ও নাগরিক উঠতি মধ্যবিত্ত জীবনের অস্তিত্ব জিজ্ঞাসার মধ্যে ব্যক্তিকে আবিষ্কার করেছিলেন রাবেয়া খাতুন এই উপন্যাসে। রাবেয়া খাতুন ভ্রমণসাহিত্য রচনাকে গুরুত্বপূর্ণ সাহিত্যকর্ম হিসাবে বিবেচনা করেছেন বলে তার ভ্রমণসাহিত্যের বইও অনেকগুলো।বেশকিছু আত্মজীবনী স্মৃতিমূলক রচনা লিখেছেন। একাত্তরের নয় মাস (১৯৯০) বইয়ে লিখেছেন একাত্তরের শ্বাসরূদ্ধকর দিনগুলোর কথা। সাহিত্যচর্চার জন্য পুরস্কার হিসেবে পেয়েছেন একুশে পদক (১৯৯৩), বাংলা একাডেমি পুরস্কার (১৯৭৩), নাসিরুদ্দিন স্বর্ণপদক (১৯৯৫), হুমায়ূন স্মৃতি পুরস্কার (১৯৮৯), কমর মুশতারী সাহিত্য পুরস্কার (১৯৯৪), বাংলাদেশ লেখিকা সংঘ পুরস্কার (১৯৯৪), শের-ই-বাংলা স্বর্ণপদক (১৯৯৬), ঝষিজ সাহিত্য পদক (১৯৯৮), লায়লা সামাদ পুরস্কার (১৯৯৯) ও অনন্যা সাহিত্য পুরস্কার (১৯৯৯)। ছোটগল্পের জন্য পেয়েছেন নাট্যসভা পুরস্কার (১৯৯৮)। সায়েন্স ফিকশন ও কিশোর উপন্যাসের জন্য পুরস্কৃত হয়েছেন শাপলা-দোয়েল পুরস্কার (১৯৯৬), অতীশ দীপঙ্কর পুরস্কার (১৯৯৮), ইউরো শিশুসাহিত্য পুরস্কার (২০০৩)। টিভি নাটকের জন্য পেয়েছেন টেনাশিনাস পুরস্কার (১৯৯৭), বাচসাস (বাংলাদেশ চলচ্চিত্র সাংবাদিক সমিতি) পুরস্কার, বাংলাদেশ কালচারাল রিপোর্টার্স অ্যাসোসিয়েশন মিলেনিয়াম অ্যাওয়ার্ড (২০০০), টেলিভিশন রিপোর্টার্স অ্যাওয়ার্ড (২০০০)-সহ তিনি এ পর্যন্ত অসংখ্য পুরস্কার ও সম্মাননা অর্জন করেছেন।
Leave a Reply