আগামী নির্বাচন সামনে—গণতান্ত্রিক ইসলামি দলগুলোর সামনে কঠিন পরীক্ষার সময়: পরস্পর শ্রদ্ধা, সহনশীলতা ও উন্নয়নপন্থী রাজনীতির উপর জোর দিচ্ছেন বিশ্লেষকরা
স্টাফ রিপোর্টার:
দেশে আসন্ন জাতীয় নির্বাচনকে ঘিরে রাজনৈতিক অঙ্গনে উত্তেজনা যখন ক্রমেই বাড়ছে, তখন বিশেষজ্ঞরা মনে করছেন—গণতান্ত্রিক ইসলামি রাজনৈতিক দলগুলোর জন্য সামনে আসছে সবচেয়ে কঠিন এবং গুরুত্বপূর্ণ সময়। কারণ, এই নির্বাচন শুধু ক্ষমতার পালাবদলের প্রতিযোগিতা নয়; বরং বাংলাদেশের রাজনীতি, সমাজ এবং জনগণের ধর্মীয়-সামাজিক বিশ্বাসকে কীভাবে দলগুলো ধারণ ও উপস্থাপন করবে—তারও একটি নির্ণায়ক পরীক্ষা। বিশ্লেষকদের মতে, ইসলামি দলগুলোর সামনে এখন দুটি পথ উন্মুক্ত—একদিকে আছে পারস্পরিক শ্রদ্ধা, সহনশীলতা ও শান্তিপূর্ণ প্রচারের মাধ্যমে ইসলামের সৌন্দর্য এবং দেশের উন্নয়ন-পরিকল্পনা তুলে ধরে জনগণের হৃদয় জয় করার সুযোগ; অন্যদিকে আছে দলীয় বিভক্তি, পরস্পরের বিরুদ্ধে দোষারোপ, ফতোয়াবাজি এবং ‘হক-বাতিল’ বিতর্কে জড়িয়ে সমাজে বিভক্তি তৈরি করার ঝুঁকি। এই দুই পথের যেকোনো একটি বেছে নেওয়া—দলগুলোর ভবিষ্যৎ অবস্থানকেই প্রভাবিত করবে।
ইসলামি মূল্যবোধ তুলে ধরা—রাজনীতিতে ইতিবাচক অনুষঙ্গ
দেশের মুসলিম জনগোষ্ঠী সংখ্যায় বৃহত্তর হওয়ায় ইসলামি দলগুলোর প্রতি জনসাধারণের প্রত্যাশাও সর্বদা বেশি। গবেষণা সংস্থাগুলোর বিশ্লেষণে দেখা গেছে, বাংলাদেশে রাজনৈতিক ইসলাম মূলত মূল্যবোধভিত্তিক সামাজিক ন্যায়, সমতা, দুর্নীতিমুক্ত প্রশাসন, মানবিক কল্যাণ এবং জাতীয় ঐক্যের ধারণার সাথে যুক্ত। বিশেষজ্ঞরা তাই বলছেন, ইসলামি দলগুলো যদি নির্বাচনকালীন প্রচারে শান্তিপূর্ণ ভাষা ব্যবহার, জাতির প্রতি দায়িত্ববোধ, উন্নত শিক্ষা ব্যবস্থা, সুশাসন ও মানবিক রাষ্ট্রব্যবস্থার মতো ইতিবাচক বার্তা তুলে ধরে, তাহলে তারা জনগণের কাছে বিশ্বস্ততা অর্জন করতে সক্ষম হবে।
একজন রাজনৈতিক বিশ্লেষকের ভাষায়—।“ইসলাম নিজেই শান্তি, সহনশীলতা ও নৈতিকতার শিক্ষা দেয়। তাই ইসলামি দলগুলো যদি এই মূলনীতি ধরে রাখে, তাহলে রাজনৈতিক অঙ্গনে তাদের গ্রহণযোগ্যতা আরও বাড়বে।” দলগুলোর বিভক্তি—আলেমসমাজে নেতিবাচক প্রতিক্রিয়া তবে উদ্বেগের বিষয় হলো—অনেক ইসলামি দলের মধ্যে রাজনৈতিক প্রতিযোগিতা এবং মতাদর্শগত বিভক্তি ক্রমেই প্রকট হয়ে উঠছে। সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে কিছু নেতার বক্তব্য, পাল্টা বক্তব্য এবং দলীয় বিরোধ অনেক সময় ফতোয়া-ধর্মীয় ব্যাখ্যার বিতর্কে রূপ নিচ্ছে, যা সাধারণ মানুষ ও আলেম সমাজ উভয়ের মাঝেই বিরক্তির জন্ম দিচ্ছে।।ধর্ম বিষয়ক গবেষকদের মন্তব্য—দেশের মোট আলেমসমাজের প্রায় ৮০ শতাংশ প্রচলিত গণতান্ত্রিক ইসলামি রাজনীতিতে সরাসরি বিশ্বাসী নন; বরং তারা ইসলামকে ব্যবহার করে দলীয় স্বার্থ হাসিল—এটিকে মোটেই সমর্থন করেন না। যদি ইসলামি দলগুলো একে অপরের বিরুদ্ধে অপপ্রচার, ফতোয়া ও ধর্মীয় বিদ্বেষ উসকে দেয়, তাহলে আলেম সমাজের বড় অংশই তাদের সমালোচনার মুখোমুখি করবে বলে সতর্ক করেছেন বিশ্লেষকরা।
জনমনে বিরূপ প্রভাব—ধর্মকে রাজনৈতিক ঢাল বানানোর ঝুঁকি
বাংলাদেশের প্রেক্ষাপটে ইসলাম জনগণের আবেগ, বিশ্বাস ও সংস্কৃতির গভীরে প্রোথিত। তাই ধর্মীয় পরিচয় বা ধর্মের ব্যাখ্যা ব্যবহার করে রাজনৈতিক প্রতিপক্ষকে আক্রমণ করা বা ‘হক-বাতিল’ বিতর্ক তৈরি করা—সামাজিক সম্প্রীতিকে নষ্ট করতে পারে বলে মনে করছেন বিশেষজ্ঞরা। তারা আরও বলেন, রাজনৈতিক বক্তব্যে ধর্মকে ঢাল হিসেবে ব্যবহার করা হলে সাধারণ জনগণের মাঝে বিভ্রান্তি সৃষ্টি হয়, রাজনীতির প্রতি অনাস্থা বাড়ে, এবং সমাজে অপ্রয়োজনীয় উত্তেজনা তৈরি হয়। একজন সিনিয়র সমাজবিজ্ঞানী বলেন—
“বাংলাদেশে ৮৫ শতাংশের বেশি মানুষ মুসলমান। তাদের বিশ্বাস নিয়ে রাজনীতিতে খেলাধুলা বা একে অপরকে তুচ্ছতাচ্ছিল্য করলে জনগণের প্রতিক্রিয়া খুবই কঠিন হতে পারে। রাষ্ট্র ও জনগণের কল্যাণে রাজনীতি—সবার প্রত্যাশা
বিশেষজ্ঞরা মনে করেন, আধুনিক রাষ্ট্রব্যবস্থায় রাজনৈতিক দলগুলোর সবচেয়ে বড় দায়িত্ব হলো জনগণকে উন্নয়ন, নিরাপত্তা, স্থিতিশীলতা এবং জীবনের মানোন্নয়ন নিশ্চিত করার পরিকল্পনা উপস্থাপন করা। ইসলামি দল হোক বা প্রথাগত জাতীয় দল—সবাইকে দেশ ও জনগণের কল্যাণকেই সর্বোচ্চ অগ্রাধিকার দিতে হবে।।বিভিন্ন গবেষণায় দেখা গেছে, দেশের তরুণ ভোটারদের কাছে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ ইস্যুগুলো হলো—শিক্ষা, চাকরি, ডিজিটাল সুযোগ বৃদ্ধি, দুর্নীতি প্রতিরোধ, স্বাস্থ্যসেবা, কৃষির আধুনিকায়ন এবং জীবনমান উন্নয়ন। তাই যেকোনো রাজনৈতিক দল যদি এসব বাস্তব ইস্যু তুলে না ধরে কেবল প্রতিহিংসাপরায়ণ রাজনীতিতে লিপ্ত হয়—তাহলে তরুণ প্রজন্ম তাদের থেকে মুখ ফিরিয়ে নেবে।
বিএনপি ও অন্যান্য রাজনৈতিক দলের প্রতি আহ্বান
বিশ্লেষকরা মনে করছেন, শুধু ইসলামি দল নয়—বিএনপি, জাতীয় দলগুলোসহ সব রাজনৈতিক পক্ষকেই দেশের বিভিন্ন সমস্যা, চ্যালেঞ্জ এবং সম্ভাবনা নিয়ে জনগণের সামনে স্পষ্ট রূপরেখা তুলে ধরতে হবে।
বিরোধী দলগুলো যদি ইতিবাচক, উন্নয়নকেন্দ্রিক এবং নীতিনিষ্ঠ রাজনীতিতে সক্রিয় ভূমিকা রাখে—তাহলে একটি সুস্থ রাজনৈতিক পরিবেশ তৈরি হবে। বিদ্বেষ, প্রতিহিংসা বা ধর্মীয় বিভাজনের পরিবর্তে পারস্পরিক শ্রদ্ধা ও গণতান্ত্রিক আচরণ—নির্বাচনকে আরও গ্রহণযোগ্য ও শান্তিপূর্ণ করতে সহায়তা করবে।।সাম্য, সম্প্রীতি ও শান্তির বাংলাদেশ—সব দলের অভিন্ন লক্ষ্য হওয়া উচিত অর্থনীতিবিদ, শিক্ষাবিদ ও নাগরিক সমাজের প্রতিনিধিরা বলছেন—বাংলাদেশের ভবিষ্যৎ উন্নয়ন নির্ভর করে জাতীয় ঐক্য, সম্প্রীতি, সহনশীলতা এবং রাজনৈতিক স্থিতিশীলতার ওপর। দলগুলো যদি পারস্পরিক দোষারোপ বা উত্তেজনা ছড়ানোর বদলে সাম্যের ভিত্তিতে উন্নয়নের প্রতিযোগিতা করে, তাহলে দেশ উপকৃত হবে।
জনগণের আশা—ধর্ম, দল বা মত নির্বিশেষে প্রত্যেক রাজনৈতিক দল শান্তি, সম্প্রীতি এবং মানবিক রাষ্ট্র গঠনে ভূমিকা রাখবে।
আসন্ন নির্বাচন গণতান্ত্রিক ইসলামি দলগুলোর পাশাপাশি দেশের সকল রাজনৈতিক শক্তির জন্যই একটি বড় চ্যালেঞ্জ ও সুযোগ। এই সময়ে দ্বন্দ্ব, ফতোয়াবাজি, ধর্মীয় বিদ্বেষ বা প্রতিহিংসা নয়; বরং উন্নয়ন, শান্তি, মূল্যবোধ, শালীন ভাষা ও গণতান্ত্রিক আচরণের মাধ্যমেই জনগণের বিশ্বাস অর্জন করা সম্ভব। দেশবাসীর প্রত্যাশা—আমরা সবাই মিলে গড়ে তুলব সাম্য, সম্প্রীতি ও সৌহার্দ্যের বাংলাদেশ।
Leave a Reply